আমার বন্ধু তাপু, নাসরীন মুস্তাফা

আমার বন্ধু তাপু

আমার বন্ধু তাপুর কথা আগেও বলেছি, এখনো বলি, সুযোগ পেলেই বলি। ওকে পাশে নিয়ে হাঁটতে ভালবাসি। ক্লাসে ওর খাতা দেখে অংক টুকতে চাইঅ টিফিন ওর সাথে ভাগ করে খেতেও আমার দারুন লাগে। এটা মোটেও বাড়াবাড়ি নয়। সারা স্কুল তাপু , বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাপুর কথায় পঞ্চমুখ থাকে; সেই ওকে বন্ধু হিসাবে পেয়ে এরকম কাজ করাটা আমার অস্বাভাবিক নয় বলে আমি মনে করি। তাপুকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দিতেও আমার দারুণ গর্ব হয়। এখন যেমন সমস্ত স্কুলে ওর নাম-ডাক, আমি জানি ভবিষ্যতে সারা দেশ, সারা পৃথিবী ওকে নিয়ে আনন্দ করবে। অবশ্যই করবে।

স্বভাব করিদের মতোই তাপু হচ্ছে স্বভাব-বিজ্ঞানী। কোন সময়, কোত্থেকে কীভাবে যে ও কী আবিষ্কার করে বসে, সেটা এই আমি, ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সে-ও ঠিক্ঠাক ঠাহর করতে পারি না, মানে পেরে উঠি না। আলু দিয়ে বাল্ব জ্বালিয়ে ও পড়ালেখা করে, পুঁইশাকের পাতা চিপে কালি বানিয়েছে, বালি দিয়ে চুম্বক, চক থেকে দেয়াশলাই, কলাপাতা থেকে কাগজ, ভাঙ্গা ইটের টুকরো দিয়ে টাইপ মেশিন- এমনি হাজারো জিনিস। বিরাট বড় মন তাপুর, বন্ধুরা চাইলেই আবিষ্কারের স্বত্ব ত্যাগ করতে পারে এক কথায়। এমন কি গত বছর বিজ্ঞান মেলায় ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া টাইপ-মেশিনটা রাজু চাইতেই ও দিয়ে দিল। অথচ কে না জানে রাজুর সাথে ওর মহা গণ্ডগোল চলছে সে ক্লাস থ্রি থেকে। আমি বাপু এটা পারতাম না। শত্রুর সাথে অমন মহানুভবতা দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তবে রাজুর সাথে গণ্ডগোল করাটা তাপুর জন্য স্বাভাবিক। যারা টিফিন টাইমে মাঠে না গিয়ে মাথা গুঁজে বাঁশ-বানরের অংক করে, আবার আচার কিনতে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে বসলে ইংরেজিতে গালাগাল দেয়, সেইসব পণ্ডিত-মূর্খদের তাপু, আমিও দু’চক্ষে দেখতে পারি না। সুযোগ পেলেই যন্ত্রণা দেওয়ার ঐকান্তিক চেষ্টায় রত হই। এখন যেমন আমি দিচ্ছি।

বিজ্ঞান স্যার ভালোভাবে বুঝিয়ে গেলেন- সূর্য স্থির, পৃথিবীও অন্য গ্রহদের মতো ঘুরছে। সব ঠিক আছে। রাজুকে প্রশ্ন করলাম, পৃথিবী ঘুরলে এই ঘরটা ঘুরছে না কেন? থার্ড বেঞ্চে বসি তো, রাজু আমাকে বরাবরই আন্ডার এস্টিমেট করে। এবারো করল।  জোরে জোরে বলল- আমি লাটিম নাকি যে, ঘুরব?

কিন্তু তুইতো ঘুরছিস।  বলল তাপু।

দ্যাখ তাপু , অহেতুক তর্ক করতে চাচ্ছি না আমি। বাসায় যাব, ট্যুটর আসবেন। সরি।

রাজু গম্ভীর হতেই তাপুও গম্ভীর হ’ল। বলল-পৃথিবী ঘুরলে হে পৃথিবীবাসী আপনি কেন ঘুরবেন না? সবকিছু যখন ঘুরছে, তখন তুই কোন কারণে বাদ যাবি বুঝিয়ে বল।

সামনে তাপু , পেছনে আমি, মাঝখানে রাজু। পালাতে পারছে না, এজন্য চুপচাপ রইল।

এই দ্যাখ, আমাদের ক্লাস রুমটাও ঘুরছে। দ্যাখ্ দ্যাখ্। এবার আমিও থমকে গেলাম। বই-এর ভাষা মেনে নিয়ে জোর গলায় চিৎকার করে বলতে পারি, সবকিছু ঘুরছে। কিন্তু যা দেখি না, তা দেখতে বললে কীভাবে দেখি? বিড় বিড় করে বললাম-কোথায় ঘুরছে? সব ঠিকঠাক্, তুই আরো…

আসলেই ক্লাস রুমটা ঘুরছিল। যেকোনো ঘরকে এভাবে ঘুরিয়ে দেখার খেলাটা ছোটবেলায় কত খেলোটা ছোটবেলায় কত খেলেছি। কোথাও দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ কেবল ঘুরতে থাকো, তারপর থেমে যাও, দেখবে সেটা ঘুরছে। ঘর হলেে এই ঘোরা বুঝতে সুবিধা হয। কেন ঘোরে এভাবে?

তাপু মহা বেয়াদবি করে রাজুর কান টেনে ধরে বলল-কানের জন্য এরকম হয়। গতি বোঝা যায় আমাদের কানের ভেতরের অংশ, যাকে অন্তঃকণ বলি, তার জন্য। এখানে তিনটি অর্ধ-বৃত্তাকার খাল আছে, যাতে এন্ডোলি নামের এক তরল পদার্থ থাকে। এই তিনটি অংশ একে অপরের সাথে ঠিক সমকোণে যুক্ত থাকে। কোনো এক দিকে আমাদের গতি কোনো একটি খালের সমান্তরালে থাকলে ঐ খালের ভেতরের তরল পদার্থও গতিপ্রাপ্ত হয়। সাথে সাথে চুলের কোষগুলো উত্তেজিত হয়ে ব্রেইনে সংকেত পাঠায়। যার ফলে আমাদের ভেতরে গতির ভাবটা আসে।

কিছুক্ষণ ঘোরার পর যখন থামি, অনুভূমিক  দিকে থাকা অর্ধ-বৃত্তাকার খালের তরল পদার্থ ঊর্ধ্বমুখী জড়তার কারণে গতিপ্রাপ্ত হয় চুলের কোষগুলো যথারীতি উত্তেজিত হয়ে বুঝে পায় না কী করবে। মস্তিষ্কে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তখন আমরা চোখের সমানে স্থির ঘরকে ঘুরতে দেখি, পাশ দিয়ে গাছ  দৌড়ে যায়- এরকম আর কত কী? পুরো ব্যাপারটা আসলে মায়া, চোখের ভুল। কিন্তু ওরকম অবস্থায় সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করি, কখন দেয়ালের ঘোরাঘুরি থামবে। নইলে কাছে গিয়ে দেখতাম, সতিই দেয়াল ঘুরছে কিনা। ঘুরতেও তো পারে!

তাপু বলল, ঘরটাও ঘুরছে। কারণ পৃথিবী ঘুরছে। এমনিতে আমরাও সেটা টের পাই না। এই খেলার মাধ্যমে ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। তবে যা-ই বল, ঘোরা যখন থামে, তখন বেশ খারাপ লাগে। সবচেয়ে ভালো হয়, যেদিন ঘোরা হচ্ছিল, একটু থেমে ঠিক তার বিপরীত দিকে ঘুরতে হবে চার পাঁচবার। তাহলে খালের ভেতরের তরল স্থির অবস্থায় এসে যাবে। তখন দেখবে, থামার পরও দেয়াল আর ঘুরছে না। সব ঠিকঠাক।

এত কিছু বলার পর রাজু নিজেও অনেকবার ঘুরল। আমরাও ঘুরলাম। দু’বার মাথার সাথে ঠোকাকি হ’ল আমাদের, কিন্তু ও আর ইংরেজিতে গালি দিল না। দেবে কি, ওর যা অবস্থা তখন! তাপুর পরামর্শ বেমালুম ভুলে গেছে ও।

গত সন্ধ্যায় হাঁড়ির গরম দুধ ছলকে পড়ল আপুর হাতে। সে কী চিৎকার ওর! আমরা সবাই ব্যবস্ত সেই চিৎকার থামাতে, তাপু কীনা উপদেশ বিলাতে শুরু করল! চুলোয় দুধ ওরকম ফুলে ফেঁপে হাঁড়ি বেয়ে পড়তে গেলে বোকার মতো জ্বাল কমানোর জন্য হাত বাড়ানো ঠিক না।  আপু অমন করতে গিয়ে তো হাত পোড়াল। এক চিমটে বেকিং সোডা ছেড়ে দিলে শান্ত হয়ে যাবে দুধ।

এ ব্যাপারেও ব্যাখ্যা আছে। দুধের অন্যতম উপাদান হচ্ছে প্রোটিন। দুধ ধরনের প্রোটিন থাকে দুধে। লম্বা প্যাঁচানো সূতার মতো এবং অপরটি বলের মতো গোল্লা গোল্লা কোষবিশিষ্ট প্রোটিন। শেষেরটা পানিতে গলে গেলেও তাপ এবং এসিডের প্রভাবে পানিতে অগলনীয় প্যাঁচানো প্রোটিনের ভেতরে পরিবর্তন ঘটে যায়।

দুধ জ্বাল দেবার আগে বাতাসের সংস্পর্শে ব্যাকটেরিয়ার কারণে ভেতরের ল্যাকটোজ পরিণত হয় ল্যাকটিক এসিডে। তখন দুধের গোল কোষবিশিষ্ট প্রোটিন শুধু আলাদা হয়ে যায়। এ কারণে দুধের অংশ হাঁড়ি বেয়ে পড়ে যেতে চায়।

এদিকে বেকিং সোডা হচ্ছে সোডিয়াম বাইকার্বনেট, ক্ষার। দুধে এক চামচ বেকিং পাউডার দিলে ঐ ল্যাকটিক এসিড প্রশমিত হয়ে যায়। জানতো, ক্ষার এবং এসিড-একটি অপরটির হজমকর্তা।

তাপুর সাথে মাঠে বসে কখনো উপুড় হয়ে পিঁপড়ের কলোনি দেখে আনন্দ পাই, অন্ধকার রাতের অসাধারণ ছন্দ শুনে স্তদ্ধ হই। তাপু আমাকে শিখিয়েছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে বেঁচে থাকাটা আরো বেশি করে অনুভব করা যায়, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আনন্দে পরিণত হয়। তাপু আমার প্রাণের বন্ধু, খুব ভাল লাগার বন্ধু। একারণেই ওর কথা সুযোগ পেলেই আমি বলি।

Related Posts

9 Comments

মন্তব্য করুন