এলিমোন-পার্ট 2 ভূতের অট্টালিকা

শহরজুড়ে উৎসব চলছে। তবে কথাটি এভাবে বললে বেশি সঠিক হবে, শহরবাসীর উৎসব চলছে। কারণ উৎসব কেবল একটি অট্টালিকায়; সেখানেই শহরের অধিবাসীরা ভিড় করছে। ফেস্টিভ্যালের নাম ‘যেমন থুশি, তেমন সাজো।

কয়েক শ তলা উঁচু অট্টালিকা অপূর্ব্ আলোকসজ্জায় মোড়ানো হয়েছে। রাতের বেলায় শহরের শেষ প্রান্ত থেকেও তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ সময়ের মেলাগুলো বিশাল মাঠে করার কোনো সুযোগ নেই। ফাঁকা জায়গা পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যর ব্যাপার। ফাঁকা জায়গা যতটুকু আছে, তা মানুষের বসতবাড়িতে সয়লাব।

প্রতি তলাতেই হইহুল্লোড় । অট্টালিকার একেক তলায় একেক রকম সাজের সমাবেশ । বিভিন্ন সাজে সজ্জিত মানুষগুলোকে দেখে দর্শনার্থী মানুষেরা বেশ ফুরফুরে-কুড়কুড়ে মেজাজ আছে । তবে তুষার ইমরান স্বস্তিতে নেই । কারণ তার কাছে এই ‘সাজা’ অর্র্থ ‘সজ্জা’ নয়; এই ‘সাজা’ অর্র্থ ‘শাস্তি’ ।এটি যেন মনুষ্যসত্তার ওপর শাস্তিস্বরূপ; মানবপ্রজাতির জন্য চরম অবমাননাকর! তার মতে, এই বিকৃত মানসিকতার সাজসজ্জা এখনই আইন করে বন্ধ করা উচিত ।

তুষার ইমরান এখন ‘ভূত’- এর তলায় । এই ফ্লোরটি বেশ ইন্টারেস্টিং! ভূতকে যে যেভাবে কল্পনা করে, সে সেভাবে সেজেছে। কেউ উপরের পাটির দুপাশের দুটো দাঁত মুলার মতো লম্বা করেছে । কেউ মাথার দুপাশে শিং তৈরি করেছে । কারওবা পেছন দিকে দেখা যাচ্ছে কাঁটাওয়ালা ভয়াল লেজ! কেউ যদি ককটেল ভূত হতে পারত অর্থ্যৎ একইসঙ্গে লম্বা দাঁত, শিং ও লেজবিশ্বিষ্ট হতে পারত; তাহলে ব্যাপারটি বেশি জমত । কিন্তু সবকিছু একসঙ্গে করতে গেলে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি । তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেককেই যেকোনো একটি অপশন বেছে নিতে হয়েছে ।

ভূতের তলায় ঘোরা শেষে তুষার উমরান এল ‘কাক’-এর তলায় । প্রতিটি তলাই বিশাল ময়দারেন মতো । সাজানো হয়েছে একেকভাবে । ভূতের তলায় বেশ অন্ধকার ছিল । কাকের তলা সাজানো হয়েছে অন্যভাবে । এই তলার একদিকে কোনো দেয়াল নেই । সেদিক দিয়ে তাকালে শহরের একপাশ পুরোই দেথা যাচ্ছে । ফাঁকা জায়গাটির কাছাকাছি যেতে ভয়ও লাগছে । কারণ এটি এক শ তলারও উপরে ।

যারা কাক সেজেছে, তাদের প্রত্যেকের পিঠের দিকে একজোড়া করে ডানা আছে । মাঝেমাঝেই সজ্জাকারীর ফাঁকা জায়গা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে উড়ে দূর-দূরান্তে নীল-নীলান্তে চলে যাচ্ছে! যুদ্ধবিমানগুলো যেমন কসরত দেখায়, তারা তেমন কসরত প্রর্দ্শন করছে ।‘ও কসরতরে নাম দেব কী, ভাবি শুধু তাই আমি’! হুম, নাম দেওয়া যেতে পারে ‘বন্ধুমনা কাকের কসরত’। কারণ তারা তো আর যুদ্ধ করছে না । অবশেষে ‘সব পাখি নীড়ে ফেরে’; কসরত দেখানো শেষে বন্ধুমনা কাকেরাও অট্টালিকায় ফিরে আসছে ।

শুধু ‘তুষার’ বা ‘ইমরান’ না বলে ছেলেটিকে বারবার ‘তুষার ইমরান’ বলার কারণ- এটিই যুগের নিয়ম । ক্যারোলাস লিনিয়াসের দ্বিপদী নামকরণের মতো এখন প্রত্যক মানুষেরও দ্বিপদী না বয়েছে । কারও নামের সঙ্গে অন্য কারও নামের মিল নেই । নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা । এগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে অথবা নামকরণের নিয়মই বা কী, সেসব আপাতত এড়িয়ে যেতে চাই । বর্ণনা সুবিধার জন্য দ্বিপদী নামও পরিহার করতে চাই ।

আসলে আমি ভবিষ্যতে বসে ঘটনাটি লিখছি । আপনারা একুশ শতকে বসে এটি পড়লেও ঘটনাটি ঘটেছে বাইশ শতকে । তবে ই একশ বছরের মানুষ যতটা এগোনোর কথা, ততটা এগোয়নি । এর পেছনেও রয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য কারণ; তবে কারণটি আমি স্বল্পদৈর্ঘ্যে বলতে চাই ।

মানুষ প্রযুক্তিতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিল; কিন্তু গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর বুকে যখন তৃতীয় বিশ্বযুব্ধ হলো, তখন এক দেশ অন্য দেশের প্রযুক্তি আর মেধাবীদের ধ্বংসের উৎসব মেতেছিল ।ফেসবুকে তখন সবার স্ট্যাটাসই ছিল, ‘রিপ পৃথিবী’ ! পৃথিবীর আয়ুষ্কাল শেষ- এমনটাই ভাবত সবাই । তাই বলত ‘রিপ   ( আর, আই, পি,) অর্থাৎ ‘রেস্ট ইন পিস’ । এখন তো প্রচলিতই হয়ে গেছে, ‘চীনের দুঃখ হোয়াংহো আর পৃথিবীর দুঃখ থার্ড্  ওয়ার্ল্ড ওয়ার শো’ । যাহোক, এটি নাতি বা পাতিকাহিনি নয়, হাতি সাইজের বিরাট কাহিনী । বিস্তারিত পরে কখনো বলা যেতে পারে ।

একুশ এবং বাইশ শতকের পৃথিবীর মধ্যে উল্লেখ করার মতো কিছু পার্থক্য আছে ।এখনকার পৃথিবীর আপাদমস্তক দূষণে দুষ্ট পৃথিবী। দূষণ নির্ণয়ের জন্য লিটমাস পেপার টাইপের কিছু থাকলে পৃথিবীর হাওয়ার নীল লিটমাস কাগজ ছোঁয়া মাত্রই সেটি জ্বলে-পুড়ে লালটুস হয়ে ফুট্টুস হয়ে যেত! দূষণ এখনকার ভয়াবহতম সমস্যা ।

একুশ শতকে পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল ছিল । কিন্তু এখন বলতে গেলে পৌনে চার ভাগই জল ! স্থলভূমি যেন বিলুপ্তপ্রায় ভূমিরূপ ! একসময় হয়তো শুধুমাত্র ‘আন্ডার-ওয়াটার মিউজিয়ামেই’ স্থলভূমির নমুনা পাওয়া যাবে । গ্রিন হাউস এফেক্টের কারণে জলবায়ুর চরম উষ্ণায়নের ফলে ‍দুই মেরুর বরফ গলে একাকার । মেরবাসিরা বলতে গেলে বরফভূমির জন্য নস্টালজিয়ায় ভোগে। অন্যদিকে বরফগলা পানিতে নিচু ভূমি ডুবে স্থলভাগের পরিমাণ খুবই কমে গিয়েছে ।

এখনকার বাতাস বিষাক্ত, পরিবেশের উপাদানগুলো দূষিত । নোংরা পানি দেখতে যেমন বিশ্রী লাগে; দূষিত বাতাস চোখে দেখা গেলে, হয়তো তেমনই বিশ্রী লাগত । আবহাওয়া মেন দাঙ্গা গ্রুপের সদস্য । জলবায়ু যেন অশা্ন্তি কমিটির মেম্বার । রোদ, বৃষ্টি, শীত-সবকিছু ভয়ংকর তেজ!

এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক জ্বালানির ভয়াবহ অভাব । উন্নয়ন বলতে কৃত্রিম জ্বালানি তৈরির কিছু পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে; তবে তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল । এই শতকের আরেকটি উন্নয়ননির্দেশক বৈশিষ্ট্য হলো সবই অনলাইনভিত্তিক । যান্ত্রিকতাও বেড়েছে বেশ । গ্রাম বলতে গেলে নেই; সবই শহর । শহরগুলো মানুষে সয়লাব ।

‘এলিমোন‘ এবং ‘এলিমোনাল ট্রিটমেন্ট’ এই যুগের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার! বর্তমানের বিষাক্ত, দূষিত, রোগগ্রস্থ, ঝিমানো, চুবানো, ডুবানো পৃথিবীতে মানুষের অভিযোজনের জন্য এই আবিষ্কারটির অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল । বছরখানেক আগের আবিষ্কার হওয়া এলিমোন-এর মাদার স্ট্রাকচার নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে । অচিরেই মানুষ পেতে যাচ্ছে ভালো কিছু । তবে আপাতত এলিমোনাল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে যে সাজসজ্জা শুরু হয়েছে, তা কেউ কেউ মেনে নিতে পারছেন না । মূলত প্রতিটি প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুই দিকই থাকে । যারা ভালোটাকে গ্রহণ করে, তারাই এগিয়ে যায় ।

তুষার মনোযোগ দিয়ে কাকের উড্ডয়ন দেখছিল । অবশ্য তার এখানের আসার উদ্দেশ্য মন-প্রাণ দিয়ে মেলা উপভোগ করা নয় । যাহোক, হঠাৎ তার কানে ভেসে এল উপরের তলার শোরগোলের শব্দ । এক নারীকণ্ঠের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে! সে দ্রুত উপরের তলার দিকে ছুটল ।

উপরে ‘ইঁদুর’ তলা । অংশগ্রহনকারীর ইঁদুরের মত দাঁত আর লেজ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । একপাশে এক মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছেন । তিনি তার বাচ্চাকে খুঁজছেন । ভিড়ের মধ্যে তার বাচ্চা নাকি হারিয়ে গেছে । এই ফ্লোরে ভিড় আছে সত্যি; কিন্তু বাচ্চা হারিয়ে যাবেটা কোথায়!

ইদানীং পুরো দুনিয়াজুড়েই বাচ্চা চুরির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে! কয়েক মাস আগেও বাচ্চা চুরির চিন্তাও কেউ করত না । আর এখন পুরোই ভিন্ন চিত্র । মা-বাবারা সবসময়ই আতঙ্কে থাকেন । বাচ্চাকে এক মূহুর্তে চোখের আড়াল করা মানেই তাকে হারানোর ঝুঁকি! প্রতিটি অনুষ্ঠানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে । তুষার এই মেলায় আসার উদ্দেশ্য, এ ব্যাপারে সতর্ক্ দৃষ্টি রাখা ।

তুষার একটি অনলাইনভিত্তিক দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করে। এখনকার সব সংবাদপত্রই অনলাইনে প্রকাশিত হয় ।মাসখানেক হলো সে বাচ্চা চুরির বিষয়টি নিয়েই অনসন্ধানী প্রতিবেদন লিখছে । যদিও এ ব্যাপারে  এখন পর্যন্ত তার কাছে কার্য্কর কোনো তথ্য নেই ।কোন চুরি চেড়েছে, চুরি হওয়া বাচ্চাগুলোকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে বা তাদের পরিণতি কী হচ্ছে –এমন অনেক প্রশ্নেরই কোনো জবাব মেলেনি ।

বাচ্চা হারানো মায়ের হাহাকারে আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল। সবাই অনেক খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু হারানো ছেলেটিকে কোথাও পাওয়া গেল না । এই মূহুর্তে সেই মাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া তুষারের কিছুই করার নেই । বাচ্চার ‍আইডি কার্ড্ তার মায়ের কাছেই ছিল। আইডি কার্ড্ বহন এ যুগে বাত্যমূলক । তুষার সংবাদপত্রের জন্য মহিলার বাচ্চার ইন্টারন্যাশনাল আইডি কার্ডটির একটি ছবি তুলে নিল ।

*আল্লাহ হাফেজ*

Related Posts

12 Comments

মন্তব্য করুন