ক্ষুদে বিজ্ঞানী, নাসরীন মুস্তাফা

ক্ষুদে বিজ্ঞানী

তাপুর আভ্যসই হচ্ছে অন্যকে চমকে দেওয়া। নিঃশব্দে চলাফেরা, ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসি, এক হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে চশমার ভেতর দিয়ে আকাশ দেখা-এই হচ্ছে তাপুর প্রাথমিক সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। সারা স্কুলের এত ছেলে-মেয়ে, অথচ যে কেউ-ই তাপুকে দেখে বলবে – ও, এই বুঝি তাপু দ্যা গ্রেট, তোমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানী ।

হুঁ, তাপু আমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানঅ। কত কী যে আমাদের বানিয়ে দেয় ও মাথা খাঁটিয়ে। যেমন ধরো, ক্লাস টেনের তফাজ্জল ভাই- এর চাঁদার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য টাকার ওপর নব-আবিষ্কৃত আজর পাউটার ছড়িয়ে দিল। পাঁচ  মিনিট পরেই দেখি তোফাজ্জল ভাই – এর বুক পকেটে কিচ্ছু নেই, বুকের চামড়া উঁকি মারছে। টাকা-কাপড় সব নীরব তাপে পুড়ে শেষ, হতচ্ছাড়াটা কিছু বুঝে উঠবার আগেই। তারপর থেকে থেকে প্রতি ক্লাসে ক্যাপ্টেনরা এসে ধর্ণা দিতে লাগল তাপুর কাছেই- ঐ পাউটার ওদেরও চাই। শেষমেষ পাউডার কমিটি না বানিয়ে আর পারা গেল না। বলা বাহুল্য, আমি ছিলাম ঐ কমিটির চেয়ারম্যান। হাজার হোক, তাপুর একমাত্র প্রিয় বন্ধু তো আমি-ই।

তাপুকে নিয়ে গল্প লেখার কোন কারণ ছিল না। তবুও লিখছি।

আমি একজন কবি। স্কুল – ম্যাগাজিনে প্রতি বছরই আমার কবিতা বের হয়। এবারেও বেরিয়েছে। এই গল্পটা কোথাও ছাপাবো না বলে ঠিক করেছি। এটা এমনি লিখলাম, নিজের জন্যই না হয় লিখলাম। আমার বন্ধু তাপুকে নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে।

তাপুর চমকে দেওয়ার ব্যাপারটা না বললেই নয়। ওপর আদর্শ হচ্ছে জুয়েল আইচ। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ও জাদু শিখবে – এটাও ঠিক করা হয়ে গেছে। যদিও এখনো খুব ভালো জাদু দেখাতে  পারে ও। আলু দিয়ে বাল্ব জ্বালানো যায়, শুনেছে কখনো? তাপু তা-ই করেছিল।

গত বছরের কথা। আমাদের ‘পানতোয়া’ স্যারের বিদ্যুৎ ক্লাসে সবাই যখন আধো ঘুম আধো জাগরণে জীবনটা  কি তা-ই ভাবছি, তাপু কনুই -এর গুঁতো দিয়ে বলল-কিছু একটা করা দরকার। এত ঝিমুনি ভাল্লাগছে না।

এদিকে পানতোয়া স্যার চিৎকার করে বার-বার একই কথা বলছেন, বাল্ব জ্বালাতে শক্তির প্রয়োজন, এই শক্তি আমরা পাই, আমরা পাই, আমরা পাই…

আলু থেকে। ফস্ করে তাপু ক্লাসে বোমা ফাটল। অমনি সবাই নড়ে চড়ে বসল। বুঝল, খেল্ শুরু হয়ে গেছে। আর ঝিমুনো ঠিক না।

পানতোয়া স্যার বাঘের মতো হুংকার দিয়ে বললেন, তাপু, আমার সাথে ফাজলামো হচ্ছে?

ভালো মানুষের মতো মুখ কাচুমাচু করে তাপু বলল, জ্বী, না স্যার।

তবে?

আলু থেকেও তো শক্তি পাওয়া যায়!

সটা তো জৈব শক্তি, যা তোর একান্ত প্রয়োজন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি। সারা ক্লাস হো-হো করে উঠলো স্যারের কথায়। তাপুও মুচকি হেসে বলল, বাল্ব জ্বালানো যাবে স্যার। আমি দেখাতে পারি।

পানতোয়া স্যার দেখতে চাইলেন।

পরের দিন। বাজারের একটা থলি এক হাতে, আরেক হাতে স্কুল ব্যাগ ধরে হাজির তাপু। ক্লাস-ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ একবার ওকে স্মরণও করিয়ে দিল, বাল্বের আলো না জ্বললে তাপুর আলো জ্বালিয়ে ছাড়বেন স্যার। একহাত উঁচিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে তাপু বলল- নো চিন্তা, বৎস। যাও, খেলো গে যাও। সাজ্জাদ মুখ কালো করে সরে গেল।

এরপর? টেবিলের উপর এক-এক করে জমা হচ্ছিল বারটি আলু এবং আরো কী সব। থলির ভেতর থেকে শেষ আলুটা বের করে হাত ঝেড়ে ঠিক জুয়েল আইচের মতোই কথা শুরু করল ও : আমাদের কাজ হচ্ছে আলুর সাহায্যে বাল্ব জ্বলে কি না দেখা।

এর জন্য যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে, বারোটি দস্তার সরু টুকরো, চব্বিশটি পেপার ক্লিপ, তামার তারের বারোটি ছোট-ছোট খণ্ড, ১.৫ ভোল্টের একটি ফ্লাশ লাইট, একটি বাল্ব এবং বাল্বটি রাখার জ্য একটি হোল্টার। এখন মোট ব্যাপারটি কী রকম তা দেখা যাক।

ও প্রথমে দস্তার টুকরোগুলো দু’ভাগ করে আলুর ভেতর ঢুকিয়ে দিল। একটি আলুতে দুটি টুকরো। এখন তামার তারগুলো দস্তার প্রতিটি টুকরোর মাথার দিকে ভাল করে জড়িয়ে পেপার-ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। এভাবে পুরো কাজ হয়ে গেলে শেষের দু’টুকরো তার বাল্ব-হোল্ডারে ঢুকিয়ে দিল।

এরপর? নাহ্! বাল্বটা ঠিক  ঠিক জ্বলে উঠলো! পানতোয়া স্যা তো হা। আর আমরা? তাপু-তাপু, জিন্দাবাদ বলে সারা স্কুল কাঁপাচ্ছি।

আবার সেবার খুব জ্বর হল। খুব জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না। কিন্তু কষ্ট সেটা না। কষ্টটা হচ্ছে, ওষুধ খেতে হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে তিতে ওষুধগুলোই যেন ডাক্তার আমার জন্য নির্বাচন করেছেন। যত যব।

তাপু এক বিকেলে এসে আমার খোঁচা মারার জন্যই ওষুধ খাওয়ার সুফল নিয়ে  বক্তৃতা শুরু করল। তারপর ধীরে ধীরে ওষুধগুলোর নাম আবৃত্তি করতে লাগল। চশমাটা ঠিক মতো নাকে র ওপর বসিয়ে পেঁচো হাসি হেসে বলল, পানির সাথে মিশিয়ে খাস বুঝি?

আমি ক্ষেপে গিয়ে বললাম, তাপু! তুই চলে যা। তোকে অসহ্য লাগছে। তোর দু’নম্বরি পেঁচো হাসি আমার খুব অসহ্য লাগছে! ঐ ওষুধগুলোর মতোই!

এহ্ হে, পাঁচটা বাজে, ওষুধ খাবি না?

ওষুধ খাওয়ার কথা কানে যেতেই আমার মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে উঠতে লাগল। এ কী যন্ত্রণ হ’ল আমার!

আমার ছোট বোন এলে তাপু বলল, ফ্রিজ থেকে বরফ এনে দে তো। তারপর ঐ বরফের একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, খুব দ্রুত খা। খা না!

কিছু বুঝতে পারছি না। যাই হোক. বরফ চিবুনো শেষ হতেই ওষুধ ধরিয়ে দিল হাতে। কী আশ্চর্য! ঔষুধের তেতো গেল কই? অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে।

বুঝলি না? বরফের ওপর জাদু!

কীভাবে?

স্বাদ গ্রহণকারী কলার ওপর বরফের ক্ষমতা দেখালাম। বরফের জন্য এগুলো স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলে। আর এই কিছুক্ষণের ভেতরই তোর ওষুধ খাওয়াও শেষ। ক্যামন বুঝলি?

ও সবচেয়ে মজা পায় তাবৎ ভালো ছাত্র আর শিক্ষকমণ্ডলীর ব্রক্ষ্মতালুতে তাপ উৎপন্ন করতে। বি সেকশনের হারুণকে একবার আচ্ছামতো নাজেহাল করেছিল ও। কারণ ছিল। টিফিন পিরিয়ডে সবাই যখন মাঠে, হারুণ তখন বাঁশ কলম দিয়ে খোঁচাচ্ছে মনোযোগ দিয়ে। তাপু এসব আদিখ্যেতা একেবারেই পছন্দ করে না। হারুণের টেবিলের ওপর বার ছয়েক তবলা বাজিয়ে তাপু জিজ্ঞেস করল, ব্রাদার, একটা সমস্যা।

কী সমস্যা? একরাশ বিরক্তি এবং অবজ্ঞা নিয়ে ব্যাটা যখন আমাদের দিকে তাকাল, দেখে আমারও পিত্তি জ্বলে গেল!

টেবিলের পাশে রাখার কালির দোয়াত তোর বুঝি?

তাপু, আমি অংক করছি। এখন…

সমস্যাটা তো তোর। খামোখা বকবক করার লোক এই তাপু নয়।  আমিও তাতে সায় দিলাম। তোর বাঁদর আর বাঁশ কিছুক্ষণ রাখ। অসুবিধা তো নেই। নিরুপায় হারুণ কলম বন্ধ করে বলল, বল্ কী সমস্যা?

তোর কালির দোয়াতের মুখ খোলা রেখেছিস্ কেন?

তাতে কী হয়েছে?

মশা যে কালি খেয়ে যাচ্ছে! ঐ দেখ।

সত্যি তাই। একটা মশা অথবা মশকী আরমসে কালি খাচ্ছে! রক্তের বদলে কালি খাচ্ছে! বিশ্বাস কর, এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। নিজের চোখে দেখলাম, অবিশ্বাস করি কীভাবে? হারুণও অবাক হয়ে দেখছে কাণ্ড! তাপু প্রশ্ন করে, কেন কালি খাচ্ছে জানিস?

হারুণ জানে না। লজ্জায় রাঙা হয়ে দু’বার মাথা নাড়ল। এই প্রথম ও কিছু জানল না! আর ধরা পড়ল কি না থার্ড বেঞ্চের তাপুর কাছে!

তাহলে শোন। মশা কেন রক্ত খায় জানিস?

ওর ভালো লাগে তাই খায়। হারুণ কথাটা বলেই বুঝল, তাপুর অগ্নিদৃষ্টি কী ভয়াবহ!

মশকবংশ বৃদ্ধির জন্য অর্থাৎ ডিম সংরক্ষণের জন্য অনেক মশকী রক্ত খায়। কোনো মশা রক্ত-ফক্ত খায় না, জেনে রাখ, মশকী খায়। রক্ত খাওয়ার আরেকটা কারণ পুষ্টি সংগ্রহ। পুষ্টি থাকলে মশকী রক্ত না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে। তাই ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা চিনি অথবা মধুর দ্রবণ খাইয়ে মশকীকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায়, রক্তের অভাবে মশকীর মাথা খারাপ হয়ে যায়। তাই খালি খাওয়ার কারণ ঐ। খাচ্ছে তৃষ্ণার কারণে, পুষ্টির অভাব হচ্ছে তাই। হতেপারে, কালির কোনো উপাদানের জন্য মশকীর খেতে ভালো লাগছে। যদিও এই ব্যবহার খুবই কম করে মশকী। তাই বলা যা, ঘটনাটা দুর্লভ।

কথাটা পছন্দ হোক বা না হোক, মানুষের রক্ত মশকীর সবচে’ প্রিয় খাদ্য। আর আটানব্বই ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা, কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর ল্যাকটিক এসিডের উপস্থিতিতে মশকী দুর্দম হয়ে ওঠে। আর অন্ধকার হলে তো কথাই নেই।

এই পর্যন্ত বলে চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালো তাপু। বলল, আমি বুঝতে পারছি না, হারুণের মতো মোটাসোটা মানুষ-শিশু থাকতে ও ব্যাটা কালি  খেতে গেল কেন? আমার সন্দেহ হচ্ছে।

লাল হয়ে হারুণ বলল, কী সন্দেহ?

আমার সন্দেহ, ওটা আদপেই হয়তো মশকী নয়। নইলে হারুণকে ছেড়ে কালি খেত না।

তাহলে, ওটা কী?

ওটা এক গোবেচারা মশা, যে কখনো রক্ত খেতেই জানে না।

 

Related Posts

11 Comments

মন্তব্য করুন