- ঈদকার্ড
—————
রমজানের সময়। ঘরের সবাই মোটামুটি রোজা রেখেছে। নীলিমাও সবার মতো রোজা রেখেছে। এখন খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। আবার দেখি ভার্সিটিও বন্ধ। এদিকে মা এর কড়া নিষেধ রান্নাঘরে একদম ই ঢোকা যাবে না। তো এখন নীলিমা শুধুই এক ঘর থেকে আরেক ঘরে পয়চারি করছে তো করছে। সময়টা যদি দুপুর না হয়ে যদি মাগরিবের আযানের আগ মুহূর্ত হতো, তাহলে ও একটা কথা ছিল। কেকা আপার রান্না দেখে ভালো ভাবে সময় কেটে যেত। কিন্তু এখন করবে তো করবে টা কি নীলিমা? এক রুম থেকে আরেকরুমে পয়চারি করার সময় ভাবতে ভাবতেই সে ক্লান্ত হয়ে, পড়ার টেবিলে বসে পড়ে।হঠাৎ টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে তার সেই পুরোনো পার্সোনাল ডায়রীটা। তার খুব মন চাচ্ছিল একটু স্মৃতিচারণ করা যাক। তাই যেই বুদ্ধি মাথায় আসলে,সেই সে ডায়েরি টা নিয়ে বসে পড়ল। বসে ডায়েরি খোলার সময়, প্রথম পাতায় নতুন ডায়েরী শুরু করার সময় ডায়েরীর সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা লিখা। দ্বিতীয় পাতা থেকে শুরু তার ছোট বেলার সব স্মৃতি। এই একদিন তার খুব প্রিয় বান্ধবীর সাথে ঝগড়া করে, তার নামে এক গাদা কথা লিখে পৃষ্ঠা ভরাট করে ফেলা। আবার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সেই বান্ধবীর সাথে সব মিটমাট হয়ে যাওয়া নিয়ে এ টু জেট লিখা। আবার কিছু পৃষ্ঠাতে তার পরীক্ষার হলের ভালো খারাপ কাহিনী লিখা। সব পৃষ্ঠাতেই মোটামুটি গোলাপের পাপড়ি ভরা ছিল। এভাবেই অনেক গুলো স্মৃতি পড়ার পর হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ল, ছোটবেলায় রোজার মাসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ যেকোন বাচ্চার কাছে তা হলো ঈদ কার্ড।
কতকগুলো রংবেরঙের ঈদকার্ড দিয়ে ভরা একগাদা পৃষ্ঠা। তাতেও আবার সুন্দর বাচ্চা আলা কতকগুলো কবিতা। এই যেমন, “আকাশেতে উড়ে, সাদা সাদা বক, তোমাকে জানাই ঈদ মোবারক”। এসব দেখে তার চোখে হঠাৎ পানি টগবগ করতে লাগল। টগবগ করা মিটিমিটি চোখ গুলো হঠাৎ ঈদ কার্ড রাখা একটা পৃষ্ঠার উপর পড়ল। বহু আগের স্মৃতি। হয়ত তখন নীলিমা ক্লাস ২ এ পড়ে। রমজান মাসে বাজারে গেলে বা রাস্তার আনাচে কানাচে তে একদল ছেলে পেলে ছোট খাটো ঈদ কার্ডের দোকান নিয়ে বসত। ২ টাকা, ৪ টাকা,১০ টাকা দিয়ে হরেক রঙের ঈদ কার্ড। সবাই তার প্রিয় মানুষ, প্রিয় বন্ধু আবার অনেকে এতো বড়লোক ছিল যে পুরো ক্লাসের সবার জন্য কিনে নিতো। নীলিমার কাছে কখনও ই এতো টাকা ছিল না। আব্বু, আম্মু কখনও বা ছোট চাচ্চুর কাছ থেকে দুই টাকা, ১০ টাকা দিয়ে নীলিমা এক গাদা ঈদ কার্ড জমিয়ে ফেলে।
তার সবসময় ই রাস্তায় যে দোকান গুলো বসত, এতো রং দিয়ে সাজাতো সেগুলো ভালে লাগত। সে রঙিন জিনিস গুলো সবসময়ই তাকে আকর্ষণ করত। একটা ছোট বাচ্চার কাছে রঙিন জিনিস অবশ্যই অন্যরকম কিছু। বড়রা যতই কাজকে ছোট বড় কাতারে ভাগ করুক। আর দামী কাজ গুলোকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকুক না কেন, একটা বাচ্চার কাছে সব কাজ ই সমান থাকে। সে আরো মজা পায় যখন কাজ টা রং বেরঙের হয় আর তার পছন্দের জিনিসের হয়। নীলিমারও রোজার সময়কার এই জমজমাট দোকান খুব পছন্দের ছিল। তাই সে ঠিক করে ফেলেছিল যে, তার সব ঈদ কার্ড নিয়ে সে রাস্তার পাশে ছোট দোকান দিবে। তো যেই কথা সেই কাজ। সে আর তার এলাকার একটা বান্ধবী মিলে রাস্তার পাশে দোকানটা দিয়েই ফেলে। ভালো লাগছিল তাদের দুজনের দোকানে বসে।
দোকানটা মূলত মাটির উপর একটা কাপড় বিছিয়ে ঈদ কার্ড সাজিয়ে রাখা। কত মানুষ আসল আর গেলো, তাদের দেখে কেউ হাসল, কেউ আদর করে কথা বলল। কিন্তু কেউ ঈদকার্ড কিনল না। তবুও যেনো তাদের মনে একটু কষ্ট নেই। তারা আকাশে উড়া পাখির মতো উড়ছে। কারণ শখটা তো পূর্ণ হলো ভাই।
সারাদিন দোকানে বসে, সন্ধ্যার একটু আগে তারা ঘরে রওনা দিল। ঘরে ঢুকার সাথে সাথে যেনো বিশাল বড় আকারের একটা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আওয়াজ হলো। আওয়াজ টা করল নীলিমার আব্বু। কে জানি তাকে খবর দিয়ে দিছে, তার মেয়ে রাস্তা বসে ঈদ কার্ড বেচতিছে। এটা কি সে সহ্য করতে পারবে? ঠাশ করে একটা চড় দিয়ে, হুকুম করে দিলো কাল থেকে কোনো বাহিরে যাওয়া হবে না।
নীলিমা ভাবতে লাগল এবার কি হবে তার দোকানের? ভাবতে ভাবতে তার মাথায় বুদ্ধি চলে আসল। সে তাদের বারান্দায় বসে ঈদ কার্ডের দোকান দিবে। তো পরদিন সকাল থেকে সে আবার বারান্দায় দোকান সাজালো। তখন তার বাবা দূর থেকে হতাশ চোখে তার মেয়ের শখ দেখতে থাকে। হয়ত ভাবে কতো কি স্বপ্ন দেখসিলাম! কিন্তু মেয়ে তাকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে ঈদ কার্ডের দোকান নিয়ে বসছে।
এভাবে ডায়েরী পড়তে পড়তে নীলিমার চোখ ক্রমেই ঝাপসা হয়ে গেলো। তখনই মাগরিবের আযান পড়ে যায়। মা তাকে ইফতারের জন্য ডাকে। নীলিমা টেবিল থেকে উঠতে উঠতে ভাবে, ” স্কুলজীবন মধুর সময়,চলে গেলে টের পাওয়া যায়।”