মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা সংগ্রামী কিছু গান রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়েছে উদ্দীপনা । এসব গান শুনলে হৃদয়ে দেশ মাতৃকার প্রতি দরদ উছলে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম-
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদী জল ফুলে ফুলে মোর স্বপ্ন আঁকা।
যে দেশের নীল অম্বরে মন মেলছে পাখা
সারাটি জনম সে মাটির টানে অস্ত্র ধরি।
মোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি
মোরা একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করি
মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি।
যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দোলে
যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে
যে গৃহ কপোত সুখ স্বর্গের দুয়ার খোলে
সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে শপথ করি।
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
বাঙালির হৃদয়ে মানচিত্রের মত লেপ্টে থাকা এ গানটি আমরা কে না শুনেছি? এ গানের জন্মকথা আমরা কেউ কেউ জানি, কেউ কেউ জানি না।
গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। এই দরদী গীতিকবির জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে। তার রচিত গানের মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘চলো বীর সৈনিক’, ‘বাংলার মাটি’ উল্লেখযোগ্য।
‘আমার সুনাম, যশ, প্রতিষ্ঠা— সবকিছু বাংলাদেশ ঘিরে।’— কথাগুলো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমাদের আপন মানুষ গোবিন্দ হালদার। এপার বাংলায় না জন্মালেও তার অবিনাশী গানগুলো মুক্তি সেনাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে। েএ দেশের সঙ্গে তার আত্মার বন্ধন যেভাবে গড়ে উঠল, তা জানা যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূর্য়সৈনিক কামাল লোহানীর বর্ণনায়।
স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, মাসের নাম মনে নেই। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘনীভূত হচ্ছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য নতুন নতুন গান প্রয়োজন। কলকাতায় আমাদের এক বন্ধু ছিল কামাল আহমেদ নামে। উনি আমাকে জানালেন গোবিন্দ হালদার নামে তার এক বন্ধু আছে। গান লেখে, আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার। সে পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান লিখেছে, আমি গানগুলো নেবো কিনা? আমি তো নতুন গান খুঁজছি। তো এরই ধারাবাহিকতায় কলকাতার চৌরঙ্গীতে একটি রেস্টুরেন্টে দেখা হলো গোবিন্দ হালদারের সঙ্গে। সেসময় তিনি দুটো খাতা আমাকে দিলেন। তার মধ্যে ২০০-৩০০ গান ছিল। আমি সুরকার সমর দাসকে দিলাম গানগুলো দেখার জন্য। এর পর আপেল মাহমুদকেও একটা খাতা দিলাম কিছু গানের সুর করার জন্য।
গোবিন্দ হালদার পূর্ববঙ্গের লোক না হয়েও পূর্ববঙ্গের মুক্তি সংগ্রামের জন্য যে আবেগ, ভালোবাসা লালন করে গানগুলো লিখেছিলেন, আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। তার লেখা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করেছিলাম। গানটি গেয়েছিলেন আপেল মাহমুদ। এর পর সমর দাস করলেন ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’। দুটো গানই সেসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। উনার লেখা মোট ছয়টি গান স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য সুর করা হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের দুই-তিনদিন পর গাওয়া হয়েছিল গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’গানটি।
কামাল লোহানীর এর পর যতবারই কলকাতা গেছেন দেখা করেছেন গোবিন্দ হালদারের সঙ্গে। শেষ জীবনে দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কম বেতনে চাকরি করতেন, রিটায়ার্ড করেছিলেন। সরকারি কোয়ার্টারে এক রুমের একটি বাসায় থাকতেন। বাংলাদেশ থেকে তাকে সে রকম সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছিল না কামাল লোহানীর মনে ক্ষোভও ছিল। তাই পরবর্তীতে কামাল লোহানী তাকে নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন। আমেরিকায় তার কিছু প্রগতিশীল চিন্তাধারী বন্ধু গোবিন্দ হালদারকে আর্থিক সাহায্য করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তৎকালীন কমিটিও কিছু সাহায্য পাঠিয়েছিল। ২০০৯ সালে কামাল লোহানী শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রীকে গোবিন্দ হালদারের বিষয়ে অবহিত করেন। তখন ১৫ লাখ টাকা সরকারের পক্ষ থেকে গোবিন্দ হালদারকে অনুদান দেওয়া হয়।
এই মহান গীতিকবি ১৭ জানিয়ারি ২০১৫ সালে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অচেনা এক সুরের জগতে প্রস্থান করেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের বন্ধু, ছন্দ-সুরের সৈনিকের জন্য বিজয় দিবসে গভীর শ্রদ্ধা।