গোলাপ গাছে বেশি ফুল পাওয়ার উপায়

গোলাপ সৌন্দর্য ও লাবণ্যের প্রতীক। সারা পৃথিবীতে যত ধরনের ফুল রয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুল হল গোলাপ এজন্য গোলাপ ফুলকে ফুলের রানী বলা হয়। গোলাপ গাছের ফুল সাধারণত শীতকালে কালে বেশি ফোটে তবে বর্তমানে সারা বছর ধরে গোলাপ ফুল চাষ করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গোলাপ ফুলের ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। বছরব্যাপী গোলাপ গাছে বেশি ফুল পাওয়ার উপায় হল গোলাপ গাছে সঠিকভাবে পরিচর্চা করা।

শীত অথবা গরমে বিভিন্ন জলবায়ুতে গোলাপ গাছ খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। গোলাপ ফুল সামাজিক, ধর্মীয় এবং বিয়ে বাড়ীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গোলাপ ফুল ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন শিল্পী গোলাপ ফুলের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

গোলাপ ফুল চাষে জলবায়ু ও মাটি

গোলাপ মূলত শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ। অতিরিক্ত গরমে এবং উষ্ণ আদ্রর্তায় গোলাপ গাছের ফুল ধরে না। গোলাপ গাছের মিনিমাম তাপমাত্রা হলো ২০ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর থেকে বেশি হলে গোলাপ গাছের জন্য ক্ষতিকর। বার্ষিক গড়ড় বৃষ্টিপাত ১০০ থেকে ১২৫ সেলসিয়াস হলে গোলাপ চাষের জন্য উপযোগী। গোলাপ চাষের জন্য উর্বর বেলে দোআঁশ মাটি খুব উত্তম। মাটির ph মান ৬-৬.৫ হলে ভালো। তাছাড়া জাত ভেদে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন তাপমাত্রার ফুলের গুনগত মানের উপর অনেকটা নির্ভর করে। গোলাপ গাছের বেশি ফুল পাওয়ার জন্য সকালের রোদ খুব কার্যকর।

গোলাপ ফুলের জাত

সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের গোলাপের জাত রয়েছে। অনুমান করা হয় সারা বিশ্বে গোলাপ ফুলের প্রজাতির সংখ্যা ১৫০ টিরও বেশি। চলুন তাহলে কয়েকটি জনপ্রিয় জাতি আলোচনা করা যাক।

১. বাংলা নামঃ অল্টিসিমো

ইংরেজি নামঃ Altissimo

উৎপত্তিঃ ফ্রান্স, ১৯৬৬

উচ্চতাঃ ৭ থেকে ৯ ফুট লম্বা

ফুলের রংঃ লাল

২. বাংলা নামঃ পাপা মিলাঁ

ইংরেজি নামঃ Papa Meilland

ফুলের রংঃ লাল

উচ্চতাঃ ৩ থেকে ৪ ফুট লম্বা

উৎপত্তিঃ ফ্রান্স, ১৯৬৩

৩. বাংলা নামঃ  রোজ গুজার্ড

ইংরেজি নামঃ Rose Gaujard

উচ্চতাঃ ৪ ফুট লম্বা

ফুলের রংঃ হাল্কা গোলাপি  বিপরীতে সাদা

উৎপত্তিঃ ফ্রান্স, ১৯৫৭

৪. বাংলা নামঃ কুইন এলিজাবেথ

ইংরেজি নামঃ Queen Elizabeth

উচ্চতাঃ ৪ থেকে ৬ ফুট লম্বা

ফুলের রংঃ গোলাপি

উৎপত্তিঃ আমেরিকা, ১৯৫৪

৫. বাংলা নামঃ ডাচ গোল্ড

ইংরেজি নামঃ Dutch Gold

উচ্চতাঃ ৩ ফুট লম্বা

ফুলের রংঃ সোনালি হলুদ

উৎপত্তিঃ লন্ডন, ১৯৬৩

গোলাপ ফুলের গাছ রোপনের সময়

বর্তমানে সারা বছরব্যাপী গোলাপ ফুলের গাছ রোপন করা হয়। তবে বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গোলাপ গাছের সারা রোপন করা উপযুক্ত সময় হিসেবে ধরা হয়।

গোলাপ ফুলের গাছের বংশ বৃদ্ধি

বিভিন্ন পদ্ধতিতে গোলাপ ফুল গাছের বংশবৃদ্ধি করা যায়। গোলাপ গাছ সাধারণত বীজ, কাটিং, গুতি কলম এবং চোগ কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়। গোলাপ গাছের ডাল কেটে সরাসরি মাটিতে পুঁতে দিলে ও গোলাপ গাছ বেঁচে যায়। গোলাপ গাছ বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করলে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়। গোলাপ গাছ বংশবিস্তারে প্রধান পদ্ধতি হল বাডিং বা চোখ কলম।গোলাপ গাছের বেশি ফুল পাওয়ার উপায় হল চোখ কলম।

যে গোলাপ জাতটি আপনার পছন্দ সেটি চোখ তুলে অপর একটি আদিজোড় বা rootstock এর উপর স্থাপন করে দিন। যদি আপনি না পারেন তাহলে অন্য কারো সাহায্য নেন। এভাবে আদিজোড়ের কলম করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা,সজীবতা,উৎপাদনশীলতা,ফুলের সৌন্দর্য, মাটি ও আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা সবকিছু বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

গোলাপ ফুলের চাষ পদ্ধতি, গোলাপ গাছে বেশি ফুল পাওয়ার উপায়

মাটি তৈরি: গোলাপ গাছে প্রচুর পরিমাণে ফুল আনতে মাটি তৈরি খুবি জরুরি। সাধারণত এঁটেল মাটিতে গোলাপ চাষের জন্য উপযোগী নয়। গোলাপ চাষের জন্য মাটি এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি উপাদান পায় এবং পানি জমে না থাকে। একটি টবের জন্য কি কি সার প্রয়োগ করবেন তা নিচে তুলে ধরলাম।

১ . বেলে- দো অংশ মাটি ১ ভাগ।
২. পচা গোবর সার বা কম্পোষ্ট সার ৩ ভাগ
৩. পাতা পচা সার ১ ভাগ
৪. নদীর বালি ১ ভাগ
৫. সরিষার খৈল ১ ভাগ
৬. চুন ১ চামচ
৭. ডিএম পি সার ২ চামচ

এই সবগুলো উপকরণ একসাথে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে টবে একমাস রেখে দিতে হবে। একমাস পরে টবে পানি দিয়ে উল্টে দিতে হবে। এছাড়াও টবের মাটিতে চা পাতা গুঁড়া ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। টবে মাটি ভরাট করার সময় একটি জিনিস খেয়াল রাখবেন টবের নিচে ছিদ্রে অংশে টুকরো টুকরো পাথরের খন্ড দিবেন রাতে পানি নিষ্কাশনের সুবিধা হয়।

টবে চাষ : টবে গোলাপ ফুল চাষ করতে হলে খোলামেলা,আলো-বাতাস পূর্ণ সকালে রোদ পড়ে এমন জায়গায় নির্বাচন করতে হবে। সকালে অন্তত ৫-৬ ঘন্টার সূর্যের আলো পড়ে। গোলাপ ফুল গাছের বিকালের রোদ পড়তে না দেয়া ভালো কারণ এতে ফুলের রং নষ্ট হয়ে যায়।

গোলাপ ফুল চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে গোলাপ গাছটিতে থেকে যাতে সম্পূর্ণভাবে রোদ করে। তাতে সবদিকে সমানভাবে বেড়ে উঠবে। যদি টবে রোপন করেন তাহলে গাছটিতে মাছে মধ্যে সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। বেশি পরিমাণে কড়া রোদ পড়লে গাছের উপড়ে ছায়া ব্যবস্থা করতে হবে তাতে গাছ ভালো থাকবে। গোলাপ গাছে বেশি ফুল পাওয়া যাবে।

গোলাপ গাছের পরিচর্যা

গোলাপ গাছে ফুল পেতে হলে গাছকে সঠিকভাবে পরিচর্চা করতে হবে। সপ্তাহে নিয়মিত গাছের অন্তত ১/২ বার পানি সেচ দিতে হবে। গাছের আগাছা জন্মালে তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। চারা গাছ যাতে অতিরিক্ত রোদ এবং ঝড় বৃষ্টি হাত থেকে রক্ষা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

গাছের ডগায় যখন কুচি বের হবে তখন বেশি পরিমাণে পানি দিতে হবে। গোলাপ চারা রোপন করার এক মাস পরপর সার প্রয়োগ করতে হবে। গোলাপ গাছে দুইটি উপায়ে সার ব্যবহার করা হয়।
১. গোলাপ গাছের রোগবালাই থেকে রক্ষা পাওয়া জন্য।
২. গোলাপ গাছের পুষ্টির উপাদান সরবরাহ করার জন্য।

গোলাপ গাছের ডাল ছাঁটাই

কলার কাছে বেশি ফুল পাওয়ার উপায় হল সঠিক সময়ে ডাল ছাঁটাই করা। গাছের বংশবৃদ্ধি, গাছের আকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি, বেশি ফুল পেতে হবে নিয়মিত ডাল ছাঁটাই খুবি জরুরি। গোলাপ গাছের ছাঁটাই করনের মধ্যে দিয়ে গাছের ঝোপালো কান্ড এবং ফুল বৃদ্ধি করা সম্ভব। গোলাপ গাছ গুল্ম জাতীয় শাখা বিস্তারকারী দ্রুত বর্ধনশীল গাছ।

এই গাছ এক মৌসুমে ফুল দেয়। ফুল দেয়া শেষ হলে সাথে সাথে গাছ ছাঁটাই করতে হয়। গোলাপ গাছের বর্ষা শেষ দিকে অক্টোবর- নভেম্বর মাসে সাধারণত ছাঁটাই করলে ভালো হয়। মূল কান্ড থেকে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি করে রেখে দিলে গাছ ছাঁটাই করতে হয়। তবে ডাল ছাঁটাইয়ের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে ডালের কান্ড কনো অবস্থায় ভেঙে অথবা ছিঁড়ে না যায়। সেজন্য ডাল ছাঁটাইয়ের সময় ভালো ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে।

গোলাপ ফুলের গাছের রোগ ও প্রতিকার

গাছের ডাল ছাঁটাইয়ের পর যখন নতুন কুঁড়ি বের তখনি গাছের রোগবালাই বৃদ্ধি পায়। তাই গাছ ছাঁটাই পরে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক মিশিয়ে পুরো গাছে প্রযোগ করতে হয়। গোলাপ গাছের যে পোকামাকড় আক্রমন করে চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।

উইপোকা : গোলাপ গাছের প্রধান শক্রু হল উইপোকা। কাটিং মাটিতে রোপন করার পর শিকর বের হওয়ার সাথে সাথেই খেয়ে ফেলে ফলে গাছ মারা যায়।

প্রতিকার: আপনি যে জায়গায় গোলাপ গাছ রোপন করবেন সেখানে যদি উইপোকা থাকার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে আগে থেকে মাটি শোধন করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে পাইরীফস কীটনাশক অথবা কৃষি কর্মকর্তা কাছে গিয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

লাল ক্ষুদে মাকড়সা : লাল ক্ষুদে মাকড়সা গোলাম গাছের জন্য একটি ক্ষতিকর পোকা। এই পোকা আক্রান্ত হলে গাছের পাতার রস চুষে খায় ফলে গাছের শাখা বৃদ্ধি হতে পারে না। আক্রান্ত গাছের পাতা ও গালে কালচে দাগ পড়ে,বেশি হলে পাতার রং হালকা মরিচা হয়ে যায় এবং পাতা শুকিয়ে যায়।

প্রতিকার : গাছের আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। যদি কখনো এই রোগ দেখা দেয় সাথে সাথে এই মাকড়সা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারে ইথিওন- ৪৬.৫,থিওভিত -৮০,কেলথেন-৪২ ইত্যাদি কীটনাশক পাওয়া যায়। সেগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এই মাকড়সার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

শ্যাফার বিকল পোকা : এই পোকা বেশ বড় এবং মারাত্মক। এরা রাতের বেলায় গাছকে আক্রান্ত করে কচি কচি পাতা খেয়ে পুরো গাছটাকে ঝাঁঝড়া করে ফেলে। ফললে গাছের নতুন কুঁড়ি ও ফুল বের হতে পারে না। সাধারণত বর্ষাকালে এই পোকা আক্রমন বেশি দেখা দেয়। এই পোকা গোলাপ গাছের মাটিতে ডিম পাড়ে এবং গোলাপ গাছের শিকড় খেয়ে ফেলে।

প্রতিকার : শ্যাফার বিফল পোকা আক্রমন করার সাথে সাথে দমনের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। যদি দেরি হয় তাহলে গাছের বৃদ্ধি হবেনা। এই পোকা দমনের জন্য পাইরিবান,পাইরিফস ইত্যাদি কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। এই পোকা রাতের বেলায় ফুরোমন ফাঁদ পেদে জৈবিক উপায়েও দমন করা যায়।

এছাড়াও শুয়ো পোকা,থ্রিপস পোকা,জাব পোকা,ডাইব্যাক, পাউডারী মিলভিউ ইত্যাদি পোকা আক্রমন করে থাকে। তাই গোলাপ গাছের বেশি ফুল পেতে হলে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

গোলাপ গাছে বেশি ফুল পাওয়ার উপায়

গোলাপ গাছের বেশি ফুল পেতে হলে আগে রোগ প্রতিরোধী গোলাপের জাত নির্বাচন করতে হবে। তেমনি একটি জাত হলো হাজারি গোলাপ। হাজারি গোলাপ একটু পরিচর্যা পেলেই প্রচুর পরিমাণে ফুল দিয়ে থাকে। তবে এই জাতের গাছ রোপন করলে একটু কষ্টদায়ক হবে কেননা এই গাছ সঠিকভাবে পরিচর্চা না করলে সহজে বেড়ে উঠবে না। তাই পরিচর্যা জরুরি। যথা সময়ে ছাঁটাই করতে হবে।

পোকা,কেঁচো ও অন্যান্য পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচাতে মা থেকে আগে শোধন করে নিতে হবে এবং গাছে অতিরিক্ত খাবার হিসেবে ফুরোডান, নিমখোল অথবা হাড় গুড়ো ব্যবহার করতে হবে। গাছে প্রচুর ফুল পেতে হলে ইউরিয়া, পটাশ,বিএনপি,গোবর সার, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সঠিক অনুবাদের মেসি নিয়ে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছকে সকালে সরাসরি সূর্যের আলোতে রাখতে হবে যাতে তাড়াতাড়ি গাছ বৃদ্ধি পায়। এই কয়েকটি নিয়ম অনুযায়ী গাছের পরিচর্যা করতে পারলে গাছের ফুল দ্বিগুণ হবে।

তো পোস্টটি কেমন লাগলো দয়া করে কমেন্টে জানাবেন, যদি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যয় শেয়ার করবেন, পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এমন সব দারুন দারুন পোস্ট পেতে Grathor এর সাথেই থাকুন এবং গ্রাথোর ফেসবুক পেইজ ও ফেসবুক গ্রুপ এ যুক্ত থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।

Related Posts

3 Comments

মন্তব্য করুন