চা। ( একটি ছোট গল্প)

টানা তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে ।রাস্তায় দুই তিনজন লোক হাতে ছাতা নিয়ে লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে । তাদের পাশে একটি ১৬-১৭বছরের একটি ছেলে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। ছেলেটির পরনে একটি শার্ট যার উপরের দুটি বোতাম খোলা এবং একটি ফুল প্যান্ট পরা ।ছেলে এমন ভাবে হাঁটছে যেন সে নিজেকে নায়ক মনে করছে। একটু দূরে বাড়ির ছাদে ৫-৬ টি বাচ্চা বৃষ্টিতে ভিজছে আর দৌড়াদৌড়ি করছে ।

এসব দৃশ্যগুলো অলক জানালা থেকে দেখছে আর রং চা খাচ্ছে ।রং চা খাওয়াটা অলকের এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে অলক। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর যে তিন মাস বন্ধ পেয়েছে সেই বন্ধেই তার এই রং চা খাওয়ার অভ্যাসটা হয়েছে ।আগে এক বেলা খেতো তবে এখন দুইবেলা সকাল-বিকাল। প্রতিবারই ওর বড় বোন চা বানিয়ে দেয়। অলকের থেকে দুই বছরের বড় ওর বোন।নাম অনন্যা ।অনন্যা ঘরের সব কাজ করে। কারণ ওদের মানেই দুই বছর আগে মারা গেছে। অনন্যা বেশ রূপবতী ।কম কথা বলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে ।

অলকের বাবা সারাদিন অফিসে থাকে ।রাতে বাড়ি ফিরে বাজার নিয়ে। অবশ্য তিনি অফিসে কাজের ফাঁকে বিকেলে বাজার করে রাখে । রাতে বাড়ি ফেরার সময় তা নিয়ে আসে। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র অলকের বাবাই নিয়ে আসে। তাছাড়া তিনি কখনো অনন্যাকে বাড়ির বাইরে একা পাঠান না। তার মতে অনন্যা একটু বোকা মেয়ে। তাছাড়া দেশের অবস্থা এখন ভালো না। একদলের বিস্তার ঘটেছে যারা নাকি মেয়ে ধরে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। তাই যেকোনো প্রয়োজনে তিনি বাইরে যান অথবা
অলক যায় ।অলক বেশ মেধাবী ছাত্র।বড় ব্যবসায়ী হওয়া তার প্রবল ইচ্ছা। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় বই পড়ে।আর সন্ধ্যায় ভাই বোন একসাথে আড্ডা দেয়।অলক কে বেশি কথা বলতে হয় আর অনন্যা চুপচাপ শুনে। মাঝে মাঝে দুই একটা কথা বলে।এদের মাঝে ঝগড়া হয় না বললেই চলে।

কিছুদিন পরের কথা। টানা দেড় দিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ সূর্যের দেখা মেলে। গত দু’দিন ঝড়ের কারণে বাড়ির বাইরে যাওয়া যায়নি। অলকের বাবা অফিসেও যেতে পারেনি। তাই আজ ভোরবেলায় অফিসে চলে গেলো কারন অফিসে অনেক কাজ জমে গেছে। যাওয়ার সময় অলককে টাকা দিয়ে বলল বাজার করে আনতে। বৃষ্টির কারন দুইদিন ধরে বাজারে যাওয়া হয়নি। রান্না করার কিছু নেই ।কলেজে কি যেন একটা কাজ আছে তাই অলক বাজার না করেই এক কাপ রঙ চা খেয়েই কলেজে যাওয়ার জন্য রওনা দিলো। এদিকে দুপুরে যে কিছু রান্না করবে তারও বাজার নেই ।আজ মনে হয় অনন্যা কে বাজারে যেতে হবে।

তাই হল। অনন্যা বাজারে টাকা নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো। বিকাল ৪ টা ৩০ বাজে। ৩০ মিনিট যাবত্ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অলক। ঘরের বাইরে থেকে তালা মারা। দুবার অনন্যা কে ফোন করেছে। ফোন বাজছে ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে ।কিন্তু ফোন ঘরে রেখে কোথায় গেল ভাবছে অলক। পাশের ঘরের আন্টিকে জিজ্ঞাসা করল সে কিছুই বলতে পারল না। বাধ্য হয়ে অলক বাবাকে ফোন করে ।অনন্যা যে ঘরে নেই এ খবর শুনে সে দ্রুত অফিস থেকে ফিরে আসে। আশেপাশে যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞাসা করছে।

পাগলের মত এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে চোখ থেকে পানি ঝরতে ঝরতে লাল হয়ে গেছে। অলকের বাবা পুলিশকে ব্যাপারটা জানিয়েছেন তাদের একটা টিম অনন্যা কে খুঁজছে ।চারদিন হয়ে গেল ।অলকের বাবা এখনো দরজা খুলে বসে থাকে ।আর ভাবে এখনই অনন্যা আসবে। আর অলকের চোখ পানিতে ভেজা থাকে সবসময় ।চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনন্যার ছবি ।এখন থেকে আর সন্ধ্যায় আড্ডা দেয়া হবেনা বোনের সাথে ।বাসায় থাকতে হবে একা একা ।ঘুমাতে গেলে বোনের কথা মনে পড়ে। খেতে বসলে বোনের কথা মনে পড়ে। আর তখনই চোখ ভিজে আসে পানিতে।

এক মাস হয়ে গেল। পুলিশ অনন্যা কে খুঁজে পাইনি ।ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসছে। অলক নিয়মিত কলেজে যায়। এখন আর অলক রং চা খায় না। ওর বাবাও নিয়মিত অফিসে যায়। দুজনকেই বেশিরভাগ সময় বাইরে খেতে হয়।

১০ বছর পর।

দেশে এখন নতুন এক কোম্পানির বেশ নাম ডাক শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে ।শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও এই কোম্পানীর পণ্য যায়। কোম্পানির নাম “অনন্যা কোম্পানি লিমিটেড”। কোম্পানির মালিক অলক। বোনের নামেই কোম্পানির নাম দেয় অলক।একদিন ব্যবসায়ের কাজে ব্যাংকক গেল অলক।সেখানে অলকের এক বন্ধু থাকে ।ব্যবসায়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পর, যেদিন সে দেশে ফিরে আসবে সেদিন এক কফিশপে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে ।বন্ধুর আসতে দেরি হচ্ছে তাই নিজের জন্য এক কাপ কফি অর্ডার করে অলক। বারবার বন্ধুকে ফোন করছে। এর মধ্যে অলকের কফি চলে এসেছে। বন্ধুকে ফোন করতে করতে কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিল। হঠাৎ অলক থমকে গেল ।যেন একদম স্থির হয়ে গেল ওর শরীর। ভাবতে লাগল এটাতো কফি না ,রং চা।আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো অনন্যার হাতে বানানো রং চায়ের স্বাদটা যেমন ছিল এই চায়েরও স্বাদটা একই রকম।

Related Posts

39 Comments

  1. অসাধারণ একটি গল্প। আমিতো গল্পের মধ্যে প্রায় ঢুকেই গেছিলাম। খারাপ লাগতেছে অনন্যার জন্য। বাট লাস্টের দিকটা থ্রিলিং চিল।

মন্তব্য করুন