জীবনে ঘটে যাওয়া একটি কালো অধ্যায়

একটি সত্য ঘটনা বলবো আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি কালো অধ্যায়। আমার সাথে যাকে দেখতে পাচ্ছেন সে আমার ছোট কালের বান্ধবী নাম সাবিনা। একসাথে থাকা খাওয়া একসাথেই সারাক্ষণ চোখে হারাতাম দুইজন দুইজনকে।একটা সময় কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না মর্মে দুজনেই কোরআন ধরে শপথ করি যা হয় হউক কখনো কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। ভালো ই চলছিলো আমাদের জীবন। একটা সময় মানুষের কটু কথা শুনতে হতো বলতো তুই পড়াশোনা করিস আর সাবিনা তো মুর্খ! তো মুর্খের সাথে কিসের চলাফেরা? পরে স্বিদ্ধান্ত নিলাম তাকে পড়ালেখা করাবো, যা কথা তাই কাজ তাকে পড়ার জন্য উতসাহ দেই সে পড়তে শুরু করে দিলো, এখন তাকে দেখলে কেউ বুঝবেনা যে সে মুর্খ ছিলো।


তো যাই হউক মাঝখানে অনেক সময় কেটে গেলো। একসময় আমারও বিয়ে হয়ে গেলো তারও বিয়ে হয়ে গেলো। দুইজন দুইদিকে চলে গেলাম কারোর সাথেই দেখা সাক্ষাৎ নাই। হটাৎ করেই একদিন দেখা। ২০১৪ ইং সাল তারিখ টা ঠিক মনে নাই, একদিন আমি এইচ এ এফ (HAF) জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যাই ঠিক তখনই আমার সাথে দেখা আমার প্রিয় বান্ধবী সাবিনার, অনেক বছর পরে দেখা অনুভূতি টা কেমন ছিলো বুঝাতে পারবো না।


জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছিস? কেন আসছিস? বললো কানের ডাক্তার দেখাতে আসছি। ডাক্তার দেখালো, আমি তার জন্য বাইরে অপেক্ষায় রইলাম, ডাক্তার দেখিয়ে বের হতেই জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তার কি বলেছে সে বললো অপারেশন করতে হবে। আমি বললাম কি বলিস। সে আমাকে ধরে কান্না করে দিয়ে বললো আমার তো সবাই আছে কিন্তু কেউ আসবেনা। তুই আমার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হলেও বাচ্চাদের জন্য তুই আমার সাথে থাকবি, তুই নিজে থেকেই আমার অপারেশন এর ব্যবস্থা করে দিবি,বললাম ঠিক আছে চিন্তা করিসনা আল্লাহর উপর ভরসা রাখ এই বলে সে চলে গেলো আমিও চলে গেলাম।
দুইএক দিন পরই আবার সে আসলো আমার বাসায় বাচ্চা নিয়ে সারাদিন থাকলো সন্ধ্যায় চলে গেলো।


আবারও ডাক্তারের কাছে এবার আমি সহ, অপারেশন এর তারিখ দিলো কন্ট্রাক্ট হলো কত টাকায় সঠিক মনে নাই।
আগারগাঁও নাক কান গলা হাসপাতালে অপারেশন করা হবে। সব কিছুই ঠিক করা ছিলো। পরের দিন আমি, তার বড় বোন তার স্বামী সহ তাকে নিয়ে চলে গেলাম হাসপাতালে। ‘একটা কথা বলে রাখছি’ হাসপাতাল টা তখন নতুন তৈরি করছে।


হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানে কিছু কাজ দিলো অপারেশন যেহেতু সেহেতু গার্ডিয়ানের সিগনেচার দিতে হবে আমি প্রথমে তার স্বামীকে বললাম এখানে একটা সই দেন, সে বললো আমি মুর্খ মানুষ সই জানিনা আপনি দেন। তারপর আমি তার আপন নিজের বড় বোন রাহিদা খালাকে বললাম খালা এখানে সই দেন সেও সই দিতে নারাজ সেও বললো তুই দিয়ে দে!


আমি বললাম এটা নিজেদের লোকের সই দিতে হয় আমি দিলে হবেনা। তখনও বললো তুই দে,ঠেলা ধাক্কা দেখে পরে আমিই সই করি। আর তাকে(সাবিনা) পরিক্ষা নিরিক্ষার জন্য নিয়ে গেলো প্রস্তুতি সম্পন্ন। তাকে নিয়ে যাবে এইসময় দেখি তার হাত পা শরির ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসছে। তখন আমি সাহস দিয়ে বললাম ভয়ের কিছু নাই স্বাভাবিক থাকতে হবে না হলে প্রেশার বেড়ে যাবে তোর সমস্যা হবে।


বুঝিয়ে সাহস দিয়ে অপারেশন রুমে দিয়েই অপেক্ষার আমরা। এর মধ্যেই কেবিন রেডি করা হয়েছে। অপারেশন রুম থেকে ডাঃ বের হয়ে বলতেছে সে ভয় পাচ্ছে আর তার প্রেশার বেড়ে গেছে তাই স্বাভাবিক হওয়ার জন্য দেরি হবে। আমরা তাকে সাহস দিচ্ছি চিন্তা করবেননা। এমন দেরি দেখে আমি তার বোন আর স্বামীকে বললাম আমি তাহলে চলে যাই কি হয় আমাকে জানাবেন বাচ্চারা বাসায় একা, তাছাড়া আমার অন্য কাজ ছিলো। তাই চলে আসলাম আমার বাসায়। রাতে তার স্বামী ফোন দিলো অপারেশন হয়েছে বললাম আলহামদুলিল্লাহ চিন্তা করবেন না আমি সকালে আসতেছি।


পরের দিন সকালে আবার হাসপাতালে গেলাম নিজের টাকা খরচ করে, দেখা করে সান্ত্বনা দিয়ে চলে আসলাম রাতে ফোন দিলাম কেমন আছে খবর জানতে। আমি তো ফোন দিয়ে বেকুব হয়ে গেছি, আকাশ থেকে পরেছি মনে হচ্ছিলো!, আমাকে বলতেছে তুই এখনই আয় হাসপাতালে, এসে দেখ ডাঃ সাবিনার মুখ ত্যাড়া করে দিয়েছে। আমিতো রীতিমতো বোবা হয়ে গেছি তার ভাই বোনের কথা শুনে। কথা ঠিক এ অপারেশন এর সময় ভাইয়েরা ছিলো না পরে গেছে আমাকে ধরতে।


আমি আবারও গেলাম হাসপাতালে গিয়ে দেখি সত্যিই মুখটা একটু বাকা লাগছে। বললাম এত নারভাস হয়েছিস নিশ্চয়ই স্ট্রোক করেছে। কিন্তু না তারা সেটা মানতে নারাজ। কি করবো ডাঃ এর সাথে কথা বললাম সে বললো যে সাবিনা অপারেশন টেবিলে স্ট্রোক করেছে প্রেশার বেড়ে গেছিলো তাকে অসুদ দিয়ে প্রেশার কমানো হয়েছে স্বাভাবিক হবার পরে আমি অপারেশন করি। বললাম এই কথা এখন তাদেরকে বুঝাবে কে।


আমাকে তো যে যেমন ভাবে পেরেছে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। পরে এটা বলতেও ছাড়েনি যে আমি নাকি ডাঃ এর কাছ থেকে পার্সেন্টিজ খেয়েছি। তখন তো আকাশ থেকে পড়লাম উপকারের এই প্রতিদান পেলাম। নিজের খেয়ে অন্যের জন্য করেছি। হায় আল্লাহ এর থেকে মরন ও ভালো ছিলো।


সবাইকে নিয়ে ডাঃ এর কাছে গেলাম ডাঃ কে যেভাবে খুশি হয়েছে অপমান করেছে। শেষে আমি ডাঃ কে বললাম ভাই জীবনে অনেক টাকা কামিয়েছেন দয়াকরে তাদের কে বলুন আমি কতটাকা নিয়েছি আপনার থেকে। ডাঃ কপালে হাত বললো এটা কেমন কথা আপনি কেন টাকা নিবেন। পরে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না কান্না করে দিলাম আর বললাম দয়া করে তাদের থেকে যে টাকা অপারেশন এর জন্য নিয়েছেন সেগুলো ফিরত দিয়ে দেন। সে অন্য যায়গায় চিকিৎসা করতে পারবে।


ডাঃ আমার কান্নাকাটি দেখে তার সম্পুর্ন টাকা ফিরত দিয়ে বললো একজন নার্ভের ডাঃ দেখান। এবারও আমিই নিয়ে গেলাম জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে ডাঃ দেখে বললো স্ট্রোক থেকেই এমন হয়েছে। কিন্তু তারা তখনও মানতে চাচ্ছেনা। কি এক বিপদে ছিলাম বুঝাতে পারবো না।


আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি তখন প্রতিদিন সাবিনা আমাকে ফোন করে অভিশাপ দিতো আমার বাচ্চাদের সহ আমাকে।। অনেক দিন এই কথা গুলো নিরবে শয়ে গেছি। ভাবতাম মনের কস্ট কমাতে আমাকে অভিশাপ দিতো, যেদিন বুঝলাম যে না সে আমাকে মন থেকেই অভিশাপ দিতো তখন আমি তাকে বললাম তুই নামাজ পরে আল্লাহর কাছে আমার নামে বিচার দিয়ে বল যে যদি আমার জন্য তোর এই সমস্যা হয়ে থাকে বা আমি করে থাকি তাহলে যেন আল্লাহ দুনিয়াতে ই আমার বিচার করেন। এই বলে আমি আর তার সাথে যোগাযোগ করিনি। ফোন দিলেও ধরিনি।


অনেক বছর পর আবার দেখা কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারিনি। একটু থেমে বললাম এটা কে সাবিনা তো। সে বললো এখন কি আর আমাকে চিনবি নাকি। তখন বুকে জড়িয়ে নিতে একটুও দেরি করিনি আর একটা ছবি নিতেও ভুল করিনি।এখনো মানুষের বিপদে পাশে থাকি থাকবো ইনশাআল্লাহ যতদিন বাচবো। অপবাদ অপমান যাই আসুক পরের জন্যই নিজের জীবনকে করে যাবো দান।

Related Posts

17 Comments

মন্তব্য করুন