জীবন কষ্টের শুধু মানিয়ে নিতে হয়

কলেজে ভর্তি হয়েছি কয়েক মাস হয়ে গেল। ঢাকায় কাছে পিছে তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকায় প্রথমে সেখানকার কোন একটি হোস্টেলে উঠছে হয়েছিল আমার। ভর্তি হওয়ার সময় হোস্টেল সম্পর্কে অনেকগুলো গান শুনলেও সেখানে থাকার কয়েক মাসের মধ্যেই টের পেয়ে যাই হোস্টেল কাকে বলে। আর সেখানে থাকতে ভালো লাগে না।

আমার এক বন্ধু বেশ কয়েকদিন আগেই হোস্টেলটি ছেড়ে দিয়েছিল।আর হোস্টেলে থাকা খাওয়ার খরচটাও ছিল তুলনামূলকভাবে একটু বেশি।আমিও অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে হোস্টেলে আর থাকব না। আমার বন্ধুর সাথে কোন একটি বাসায় সাবলেট থাকবো। মা-বাবা প্রথমে রাজী হতে চাইনি। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি।

আমার বন্ধুকে নিয়ে ওই এলাকাতেই একটি সাবলেট বাসা খুঁজে বের করলাম। এক রুম ভাড়া দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে খরচ ৫০০০ টাকা। যত আমরা দুইজন ছিলাম সেহেতু প্রত্যেকের আড়াই হাজার টাকা করে খরচ পড়বে। খরচ টা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সেই বাসাই ঠিক করলাম। আমার বন্ধু তার মাকে নিয়ে থাকবে আর আমি একা থাকবো। ঢাকায় বুয়ার রান্না খাওয়া কষ্টকর বলেই বন্ধুর মা থাকতে রাজি হয়েছিল। বন্ধু এসেছিল গ্রাম্য এলাকা হতে আর আমি ছিলাম উপশহর হতে। বিগত সারাটা জীবন মা বাবার সাথে থাকা হয়েছে। বাইরের দুনিয়া কেমন, কেমন সেখানকার বাসিন্দা সে সম্পর্কে কোন আইডিয়া ছিলো না আমার।আমি সবাইকেই ভালো সাদাসিধা ভাবতাম।

যাই হোক, হোস্টেলটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমি হোটেলের মালিকের সাথে কথা বললাম। সে বেশ রাগান্বিত হয়ে পরলো। যদিও সে মুখে বলে নি তবে তার হাবভাব দেখে ঠিক ভালোই বুঝতে পারলাম। চলতি মাস শেষ হয়ে গেলেই হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে। হোস্টেলের মালিক আরেকজন ছাত্রকে পেয়ে যাওয়ায় আমার জিনিসপত্র বস্তায় ভরে রেখে দিল এবং মাস শেষ হওয়ার আগেই আমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে বলল। বলতে ভুলে গিয়েছি, অসুস্থতার কারণে আমি ওই মাসে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। এতে হোস্টেলের মালিক সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। আমাকে যেনো বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় তার একটি আদর্শ ব্যবস্থা করেছিল।

আমি আমার বন্ধুকে বলেছিলাম আমার জিনিসপত্রগুলো তার বাসায় কয়েকদিন রাখতে, নতুন বাসায় উঠার দিন সব মাল-সামানা নিয়ে একত্রে উঠবো। সে রাজি হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা সেই সাবলেট বাসায় উঠে পড়ি। বাসাটির তিনটি রুমের মধ্যে একটি তে থাকতাম আমরা, আরেক টিতে থাকতো ওই মালিক আর অন্য রুমটিও ছিল ভাড়া দাও। এইভাবে থাকার অভিজ্ঞতা আমার কখনো ছিল না। ভাড়াটিয়ার স্ত্রী ছিলেন একটু মোটা আর ভীষণ রাগী। বেচারা লোকটি ছিল তার পরিবারের একমাত্র এর উৎস। কোন একটি কোম্পানিতে চাকরি করতো। তাদের একটি সন্তানও ছিল। যতদিন ওই বাসায় ছিলাম বেশিরভাগ সময়ই দেখতাম তাদের মধ্যে কোন না কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই আছে। লোকটির বৃদ্ধ মা-বাবা গ্রামে থাকতো। পাশের ঘরে অসুখ-বিসুখ তাদেরকে জেঁকে বসেছে। বউয়ের ভয়ে না জানিয়ে মা-বাবাকে সে আর্থিক ভাবে সাহায্য করতো।

একদিন তার স্ত্রী তাকে তার সম্পূর্ণ বেতনের হিসাব দিতে বলে। পরে সে জানতে পেরে যায় যে তার স্বামী তার বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করার জন্য কিছু টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কোনকিছুর পরোয়া না করে নিউজ স্বামীকেই বেধড়ক মারা আরম্ভ করে দেয় সে। আমার যতদূর মনে হয় তাদের এই চিল্লাপাল্লা এবং মারামারির শব্দ আশেপাশের বাসার মানুষ ও শুনতে পেয়েছিল। তাদের নিজ বাসাতেই যে অন্য আরও মানুষ বাস করত তার কোনো তোয়াক্কা ছিল না ওই মহিলার। প্রায় ৩০ মিনিটের মত স্ত্রীর নির্যাতন সহ্য করেও সেই লোকটিকে চুপ থাকতে দেখেছিলাম।বেশ কিছুক্ষণ শারীরিক নির্যাতন সহ্য করার পর তার ওপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতন।

যাইহোক, ছেলেমানুষ এতটা ধৈর্য ধরতে পারে আগে কখনো দেখিনি। আর এর আগে এইরকম মেয়ে মানুষ ও কখনো দেখিনি। কিন্তু আমরা এতটা ধৈর্যশীল ছিলাম না। ওইদিনই ভাড়াটিয়াকে জানিয়ে দিয়েছি যে আমরা বাসার ছেড়ে দিচ্ছি। এখানে আমাদের পক্ষে থাকা সম্ভব না। লোকটির প্রতি সহমর্মিতা দেখানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমাদের।

Related Posts

8 Comments

মন্তব্য করুন