জীবন বদলে দেওয়া একটি ভাল লাগা গল্প।

“ব্ল্যাক ডায়মন্ড”

মাত্র দুইদিন টিউশনি করানোর পর তৃতীয় দিন ছাত্রীর মা বাশারকে ডেকে তার হাতে একটা খাম দিয়ে বললো –

ঃ কাল থেকে আর আমার মেয়েকে তোমার পড়াতে হবে না। তুমি আমার মেয়েকে দুই দিন পড়িয়েছো। আমি তোমাকে পুরো মাসের টাকাই দিলাম।

বাশার অবাক হয়ে ছাত্রীর মাকে বলল –

ঃ আন্টি কিছু মনে না করলে জানতে পারি আমার অপরাধটা কি?

আন্টি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো –

ঃ না, তোমার কোন অপরাধ নেই। এমনিতেই তোমাকে আসতে হবে না।

বাশার তখন ছাত্রীর মাকে বলল –

ঃ আন্টি আমি আপনার মেয়েকে এক মাস পড়াই। তারপর যদি আপনার মনে হয় আমি আপনার মেয়েকে ঠিক মত পড়াতে পারছি না, তখন না হয় আমাকে বাদ দিয়ে দিবেন। আমার আপত্তি থাকবেনা।

এইবার ছাত্রীর মা বাশারের দিকে তাকিয়ে বললো –

ঃ আসলে আমার মেয়ে তোমার কাছে পড়তে চাচ্ছে না। শুধু ভালো পড়ালেই হয় না একটু দেখতে শুনতেও ভালো হতে হয়। তোমায় দেখলে না কি আমার মেয়ে ভয় পেয়ে যায়…!

বাশার আন্টির হাতে খাম দিয়ে বলল –

ঃ টিউশনি করাতে হলে যে ফর্সা ও ভালো চেহারার অধিকারী হতে হয় তা আগে জানতাম না। বিশ্বাস করুন যদি জানতাম তাহলে আমি আপনার মেয়েকে পড়াতে আসতাম না।

বাশার ছাত্রীর বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাটছে। তার মনে পড়ছে কলেজ জীবনের কথা। কলেজে একবার একটা অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার জন্য স্যার ভালো একজন উপস্থাপক খুঁজছিলেন। বাশার সবার সামনে হাত তুলে বলেছিল –

ঃ স্যার, আমি ভালো উপস্থাপনা করতে পারি। স্কুলে পড়ার সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি উপস্থাপনা করতাম..

স্যার বাশারের দিকে ভালো করে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলো –

ঃ তোর মত কাউয়া (কাক) যদি উপস্থাপনা করে তাহলে অনুষ্ঠানে যে কয়জন মানুষ আসবে সেই মানুষগুলোও পালাবে।

স্যারের এই এক কথাতে রাতারাতি বাশারের নাম আবুল বাশার পিয়াস থেকে “কাউয়া বাশার পিয়াস” হয়ে গিয়েছিলো। তখন থেকে আর কেউ তাকে আবুল বাশার পিয়াস নামে চিনতো না। সবাই চিনতো “কাউয়া পিয়াস” নামে।

কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা যাচ্ছিল বাশার। তার পাশের সিটে বসেছিলো সুন্দরী একটা মেয়ে। বাশার যখন তার সিটে বসতে যাবে তখনি মেয়েটা নাক মুখ ওড়না দিয়ে চেপে ধরলো। বাস কিছু দূর যাবার পরেই মেয়েটা বাসের কন্ট্রাক্টরকে ডেকে বললো –

ঃ আমায় এই সিটটা পাল্টে দেন তো। আমি অন্য কোথাও বসবো।

বাসের কন্ট্রাক্টর বাশার এর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। তারপর মেয়েটাকে বললো –

ঃ আপা, এই লোকটা কি আপনার সাথে কোনও অসভ্যতা করেছে? যদি কোনোরকম কিছু করে থাকে তাহলে বলেন, আমি এখনি লোকটাকে বাস থেকে নামিয়ে দিব। কন্ট্রাক্টরের মুখ থেকে এমন কথা শুনে বাসের অন্য সব যাত্রীরা বাশারের উপর ক্ষেপে উঠলো। একজন লোক চিৎকার করে বললো –

ঃ অবশ্যই নোংরামি করেছে। তা না হলে আপা সিট ছেড়ে উঠতে যাবে কেন।

এক ভদ্রমহিলা মুখ বাঁকিয়ে বললো –

ঃ চেহারা দেখেই বুঝা যায় বদমাইশ টাইপ ছেলে। এইসব কুলাঙ্গারদের জন্য মেয়েদের রাস্তাঘাটে চলাচলই এখন দায় হয়ে পড়েছে।

এমন একটা অবস্থা হয়ে পড়েছিলো যে বাসের সবাই মিলে এখন বাশারকে মারতে আসবে। সে বহু কষ্টে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে বলল –

ঃ আপনি আমার ছোট বোনের মত। আমি কি আপনার সাথে কোন নোংরামি করেছি?

ঃ না। (মেয়েটা মাথা নিচু করে বললো)

বাশার তখন বাসের যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলল –

ঃ ভাই আমার অপরাধ কি জানেন? আমার অপরাধ হলো আমি দেখতে কালো। আপনাদের মত সাদা চামড়ার কিছু মানুষ মনে করে আমাদের মত কালো মানুষের গা থেকে গন্ধ বের হয়। আপনাদের ধারণা পৃথিবীর সমস্ত খারাপ মানুষই কালো হয়৷

যে ভদ্রমহিলা তাকে বদমাইশ, কুলাঙ্গার বলেছিলো সেই মহিলার কাছে গিয়ে বলল –

ঃ আপনি আমার চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন আমি বদমাইশ? আপনি কি আমাকে বদমাইশি করতে দেখেছেন?  আমি কোনো বদমাইশি করা তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকাই নি পর্যন্ত!

একদিন বাশার নিউমার্কেট গেল কিছু শপিং করতে। এমন সময় তার রুমমেট রাকিব তাকে ফোন দিয়ে বললো –

ঃ মেসে আসার সময় দোকান থেকে আমার জন্য একটা “ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম” ক্রিম নিয়ে আসিস তো। আমি তোকে পরে টাকা দিয়ে দিবো।

বন্ধুর কথা মতন কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে ক্রিমের কথা বলতেই দোকানের ছেলেটা বাশারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর তার হাতে ক্রিমটা দিতে দিতে বললো –

ঃ ভাই, টাকা গুলো শুধু শুধু জলে ফেলবেন। আপনার যে কালার আপনাকে যদি ৩ দিন ৩ রাত হুইল পাউডার দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়, তবুও আপনার কালারের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হবে না।

ছেলেটার কথা শুনে বাশারের মনে হচ্ছিলো ওর গালে একটা সজোরে থাপ্পড় মারে। কিন্তু ওরই বা কি দোষ? দোষ তো তার ভাগ্যের।

দোকান থেকে বের হয়েই বাশার তার মাকে ফোন দিল। মা ফোনটা রিসিভ করতেই মাকে বলল –

ঃ মা, শুনেছি বাবা মা কোনো পাপ করলে তার দায়ভার সন্তানের উপর এসে পড়ে৷ তোমরা কি কোনো পাপ করেছিলে যার ফল স্বরূপ তোমাদের ঘরে আমার মত একটা কালো ছেলে জন্ম নিলো?

মা তার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললো –

ঃ তুই আবার তোর গায়ের রঙ নিয়ে মন খারাপ করছিস? তুই কালো তাতে কি হয়েছে? তুই আমার কাছে সোনার টুকরো ছেলে।

মা কেঁদে দিয়েছিলো দেখে বাশার তার মাকে হাসানোর জন্য বলল –

ঃ দেখলে মা কালো বলে তুমিও আমায় তেমন ভালোবাসো না। যদি ভালোবাসতে তাহলে সোনার টুকরো না বলে হীরের টুকরো বলতে।

তার কথা শুনে মা হাসতে হাসতে বললো –

ঃ তুই আমার কোহীনূর হীরার টুকরো ছেলে  !!

সবাই বাশারকে কালো বলে দূরে সরিয়ে রাখলেও  তার মা – বাবার দোয়া সবসময় তার সাথেই ছিলো। আর সে জন্যই হয়তো সে খুব ভালো একটা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই তার উপর বাবা মা অত্যাচার শুরু করলো বিয়ের জন্য। অগত্যা সেও বিয়ে করবো বলে রাজি হলো, তবে একটা শর্ত দিয়ে। বিয়ে করলে সে কালো কোন মেয়েকেই করবে।

বাশার আজ মেয়ে দেখতে যাবে। মাকে ডেকে বলল –

ঃ মা, মেয়ে দেখতে কালো তো?

ঃ আমি মেয়েকে এর আগেও দেখেছি। মেয়ের গায়ের রঙ কালোই। কিন্তু আজ আমরা দেখতে যাবো বলে মেক-আপ করে হয়তো সুন্দরী হয়ে যাবে। তবে চিন্তা করিস না। মুখ ধোঁয়ার পর মেয়ে আবার কালো হয়ে যাবে!

বাশার মেয়ের বাসায় ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করছিল মেয়ে দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পর মেয়ে আসলো। মেয়েকে দেখেই কয়েক মিনিটের জন্য সে হতভম্ব হয়ে গেল। একটা মেয়ে কি করে এত সুন্দর হতে পারে!! ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মুখে কোন মেকাপ নেই। শুধু চোখে হালকা একটু কাজল আছে। মেয়ে দেখা শেষ হলে সে তার মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল –

ঃ মা, তুমি না বলেছিলে মেয়ে কালো? এই মেয়ে তো দেখছি বেজায় সুন্দরী। শুধু সুন্দর না ভয়ংকর রকম সুন্দরী। তোমায় আগেই বলেছিলাম, আমি নিজে যেমন কালো ঠিক তেমন মেয়েই বিয়ে করবো।

তার কথা শুনে মা বললো –

ঃ আরে মেয়ে সুন্দর না। মেক-আপ করেছে তো তাই সুন্দর লাগছে।

ঃ কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছো মা। মেয়ে কোনো মেক-আপ করে নি। এত সুন্দর একটা মেয়ে। হয়তো ও চাইবে ওর স্বামী যেন খুব সুদর্শন হয়। আমার সাথে বিয়ে হলে দেখা যাবে মেয়েটার লাইফটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আমার সাথে একটা সেলফি তুলতে পারবে না। বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লজ্জা পাবে। একসাথে ঘুরতে লজ্জা পাবে!

মা কাঁদতে কাঁদতে বললো –

ঃ তুই কালো হয়েছিস দেখে কি একটা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে পারবি না?

ঃ না, পারি না মা! একটা সুন্দরী মেয়ে কখনোই একটা কালো ছেলেকে বিয়ে করতে চায় না। যদি কখনো বিয়ে করতে রাজি হয় তাহলে ভেবে নিবে হয় মেয়েটা বাবা মায়ের চাপে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। নয়তো কালো ছেলেটার খুব ভালো ক্যারিয়ার আছে সেজন্য রাজি হয়েছে।

দুপুরে অফিসে বসে কাজ করছিল বাশার। এমন সময় একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলো। ফোনটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠ –

ঃ আমি শ্রাবণী। কাল আপনারা যে মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলেন আমিই সেই মেয়ে।

বাশার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল –

ঃ আপনি আমায় হঠাৎ ফোন দিলেন যে?

ঃ আমি আপনার অফিসের নিচে। দয়া করে একটু আসবেন? আপনার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে।

একটা রেস্টুরেন্টে বাশার আর শ্রাবণী মুখোমুখি বসে আছে। রেস্টুরেন্টের অনেকেই তাদের হা করে দেখছে। বাশার চেয়েছিল রেস্টুরেন্ট বাদে অন্য কোথাও বসতে কিন্তু মেয়েটিই তাকে জোর করে এইখানে নিয়ে আসে।

কফির মগে চুমুক দিতে দিতে শ্রাবণী বললো –

ঃ সত্যি বলতে আপনাকে আমার প্রথম দেখাতে ভালো লাগে নি। কিন্তু আড়লে যখন আপনি আপনার মায়ের সাথে কথা বলছিলেন আমি আপনার সব কথা শুনে নিয়েছিলাম। তারপর থেকেই আপনাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি। এক মিনিটের কথা শুনে যে কাউকে ভালোবেসে ফেলা যায় সেটা যদি আমার সাথে না ঘটতো তাহলে আমি হয়তো কখনোই বিশ্বাস করতাম না।

ঃ তারমানে আপনি আমায় করুণা করছেন?

মেয়েটি কফির মগটা রেখে তার হাত ধরে বললো –

ঃ তুমি আমায় একবার সুযোগ দাও। আমি তোমায় এতটাই ভালোবাসবো যে মেয়েদের সম্পর্কে তোমার ধারণাটাই পাল্টে যাবে।

ডাক্তারের চেম্বারের সামনে বসে আছে বাশার। এমন সময় ডাক্তারের চেম্বার থেকে তার ছাত্রী পিহু আর ওর মা বের হয়ে এলো। বাশার আন্টিকে সালাম দিয়ে বললাম –

ঃ আন্টি আমায় চিনতে পেরেছেন? আমি আপনার মেয়েকে দুইদিন পড়িয়েছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিনের দিন আমায় বের করে দিয়েছিলেন।

ঃ হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি বাবা।

এমন সময় রুম থেকে শ্রাবণী এসে বললো –

ঃ সরি সরি, আজ রোগীর চাপ বেশি ছিলো তাই দেরি হয়ে গেলো। তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম তাই না?

বাশার তখন আন্টিকে বলল –

ঃ আন্টি, আমার স্ত্রী শ্রাবণী। আর শ্রাবণী, ও হলো পিহু। একসময় আমার ছাত্রী ছিলো।

শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো –

ঃ হ্যাঁ আমি জানি ওর নাম পিহু। আমিই ওর ট্রিটমেন্ট করছি।

আন্টি আর পিহু তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। বাশার হেঁটে যেতে যেতে শ্রাবণীকে জিজ্ঞাসা করলো –

ঃ পিহুর কি হয়েছে?

শ্রাবণী বললো –

ঃ ওর প্রাইভেট টিচারের সাথে ওর শারিরীক সম্পর্ক ছিলো। এতে সে একসময় প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। কোন এক  ক্লিনিকে যেন এবরসন করিয়েছিল। তাতে কি যেন একটা সমস্যা হয়েছিল। বিয়ের পর এখন আর বাচ্চা হচ্ছে না।

হঠাৎ শ্রাবণী দাঁড়িয়ে বললো,

ঃ আচ্ছা! ঐ টিচারটা কোনোভাবে তুমি নও তো?

বাশার রেগে গিয়ে বলল –

ঃ আমি কেন হতে যাবো? আমি কালো বলেই তো আমাকে ৩ দিনের দিন বের করে দিয়েছিলো।

তার কথা শুনে শ্রাবণী হাসতে হাসতে বললো –

ঃ নীল শার্টে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে।

ঃ কাউয়ার মত লাগছে!?

তার কথা শুনে শ্রাবণী তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে –

ঃ যে ছেলে নিজে নিজেকে সম্মান করতে চায় না, তাকে অন্যেরা কিভাবে সম্মান করবে?

শ্রাবণী রাগ করে একা একা হাঁটছে। আর বাশার ওর পিছু পিছু যেতে যেতে ভাবছে

“কালো কলঙ্কের দাগ হলেও, কালোকে বাদ দিলে সাদা অসম্পূর্ণ থেকে যায়”।

Related Posts