পরীক্ষার দেড় ঘণ্টা আগে

আচ্ছা, এই যে কঙ্কালসার সুপারি গাছ ঘেঁষে বসে থাকা বাদামওয়ালার দৈনিক আয় কতো? এই পাঁচ মিনিটেই তো দেখলাম অনেকজনকে কিনতে। কতজন কিনল? ছয় সাত জন হবে মনে হয়। নাকি তার বেশি? সে যাই হোক। দশ টাকার বাদাম ভাজা বিক্রি করলে তার লাভ থাকে কতো সব মিলিয়ে? ভালোই হয়তো, তা নাহলে তো আর এম্নি এম্নি কেউ এই ব্যাবসা করবে নাহ।

নাহ, কি সব ভেবে চলেছি। দেড় ঘন্টা বাদে যেখানে আমার এক্সাম, সেখানে এই ঘাসের ওপর বসে বই থেকে মুখ তুলে এক বাদামওয়ালার লাভ লোকসান হিসাব করা যে এক ভীষণ রকমের অপরাধ তা বুঝতে তেমন বাকি নেই। ভাগ্যিস মনের কথা আশপাশের লোকজনগুলো শুনতে পায়না, তা না হলে আম্মু যে বড় এক তুলকালাম বাঁধিয়ে দিত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

“আচ্ছা, কি করতো আম্মু? এতো লোকের মাঝে আমায় কি কান মলানি দিতো? তখন আম্মুর মুখের ভাব কেমন হতো?”, কল্পনা জগতে গিয়ে আম্মুর মুখ দেখে হেসে উঠলাম মনে মনেই। আম্মু যে এই হাসিমাখা মুখ দেখলেই আমার দিকে তীর্যক রেখামতো তাকাবে তা ভাবতেই আম্মুর মুখের দিকে তাকালাম ,মনে হয় আজ কপালটা ভালো। আম্মু অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো বলে রক্ষা। তা নাহলে ডজনখানেক প্রশ্ন এখনই করে বসতো।
এডমিশন ক্যানডিডেট হয়ে এসব ভাবতে যাওয়া মহাপাপ, তিথী। ফোকাস অন রিডিং, নিজেকেই নিজে বাবা টাইপের জ্ঞান দিয়ে দুহাতে ধরে রাখা প্রশ্নব্যাংকের দিকে মনোযোগ দিলাম।

তবুও পড়ার ভেতরই ঘুড়ে ফিরে সেই বাদামওয়ালার কথা মাথায় আসছে। এবার প্রসঙ্গটি একটু অন্যরকম। মানে যদি এমন একটা রেস্টুরেন্ট খোলা যায়, যেখানে সব মেন্যুই হবে বাদাম দিয়ে। নাটশেলগুলোও ব্যবহৃত হবে ডেকোরেশনের কাজে? নাহ আইডিয়া টা খারাপ না মনে হচ্ছে। কিছুটা ক্রিয়েটিভ করে করলে ভালোই চলবে মনে হয়। আইটেমগুলোর নামেও থাকবে ভিন্নতা। যেখানে আমার স্বপ্নের ডানা, পাখা এক এক করে গজাচ্ছে, সেখানে আমার মা আমার দিকে কৌতুহলে তাকিয়ে আছে।

বই থেকে মুখ যদিও তুলিনি, তবুও মনে হচ্ছে এবার আম্মু আমার মনের কথা বুঝে গিয়েছে। বললেন, “ পড়া বাদে কি ভাবিস?” মায়ের এমন প্রশ্নের বেগ সামলাতে আমি এমন এক সিরিয়াস মুডে মায়ের দিকে তাকালাম যেনো আমার পড়ায় তিনি বড় রকমের বিঘ্ন করে ফেলেছেন এমন একটা প্রশ্ন করে। মনে হয় এই ভাবটা কাজে দিয়েছে। জিনিসটা আর বেশিদূর গড়ালো না।

ভাবছি গতকালের ৪ ঘন্টা জার্নি আর আজকে এই কড়া রোদের মাঝে বসে থেকেও মাকে সুস্থ বলেই মনে হচ্ছে যেখানে হাইপ্রেশার, বাত ব্যাথাসহ গোটাকতক রোগের সাথে তার প্রতিদিন ওঠানামা। হয়তোবা তিনি অসুস্থ বোধ করছেন, তবে মুখে তার ভাবলেশ নেই।
কিন্তু আমি আর মা কেনো যে এখানে বসে আছি! কেনো যে এডমিশনের এমন নিয়ম!

নিউটনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সুত্রই হোক বা সে অর্গানিক কেমিস্ট্রিই হোক, আমায় এগুলো কখনোই টানে নি। কিন্তু বাবা মায়ের চোখে স্বপ্নের পাহাড় আর গতানুগতিক এ+ পেয়ে সমাজের চোখে ভালো স্টুডেন্ট হবার সুবাদে ঝোঁকের বশে সাইন্স নিয়েছি। ঝোঁক কাটলেও চেইঞ্জ করব করব করেও কিভাবে যেনো এসএসসি শেষ করলাম। এক আকাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট, গণ্য মান্য আত্মীয় আর পাশের বাসার আন্টিদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং প্রেসকিপশন, ভালো স্টুডেন্টের তকমা লাগা আমি গতানুগতিকে গা ভাসালাম।

এরপর কতো রাসায়নিক সংকেত বুদবুদ করে উড়ে গিয়েছে, আপেক্ষিকতার সুত্রগুলো যে মাথায় মাইগ্রেন সম ব্যাথা তুলেছে তা আর নাইইই বলি। মায়েরা তো জানে না, বৃষ্টিতে গাড়ির সামনের কাঁচ ভিজলেও পেছনের কাঁচ ভিজেনা কেনো, এমন টাইপের প্রশ্নের উত্তর পড়ে কী হবে এসব নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠাই ছিলো আমাদের বন্ধুমহলে সাধারণ বিষয়বস্তু।

সে যাই হোক, অতঃপর করোনা মহামারী; অনিশ্চয়তায় ভাসতে ভাসতে অটোপ্রমোশন, ভার্সিটি কোচিং। সবকিছুর মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করতে ব্যর্থ আমি আজ এই খোলা মাঠে বসে বাদামওয়ালার আয়-ব্যায়ের হিসাব নিয়ে বসেছি।

আজ যেনো মনে হচ্ছে বাদামওয়ালা না হলেও নিজের কিছু একটা নিজস্ব পরিচয় হওয়া উচিত। তাহলে কেনো এই এক্সাম? আর কেনোই বা সাইন্স? পাবলিকে চান্স পেলে তো আবার সেই সাইন্সের সাথে বসবাস। এক অনিচ্ছা নিয়ে বই এর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাদামওয়ালার কথা ভাবছি, আর ভাবছি আমার রেস্টুরেন্টের কথা। কিন্তু এর মাঝে এ কার কণ্ঠ! কানটি একটু সজাগ করতেই বুঝলাম মা ডাকছে।

ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হলাম মায়ের কথায়। ভাবছি, রেস্টুরেন্ট পরে, পাবলিকে চান্স না হলে শেষে আমায় যে গৃহ ত্যাগ করে ফুটপাতে যেতে হবে, এটা নিশ্চিত। যেখানে হাতে আছে মাত্র এক ঘন্টা, মাউন্ট এভারেস্ট উচ্চতাসম মনোযোগ নিয়ে আমি এখন বইয়ের লিখাগুলো গিলে চলেছি। আল্লাহই এখন ভরসা। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

Related Posts

16 Comments

মন্তব্য করুন