“ডিভোর্সি ছেলে, তার উপর তিন চার বছরের একটা বাচ্চাও আছে, সেই ছেলের সাথে বিয়ে করবি তুই? লজ্জা শরম বলে কি কিছুই নেই তোর? আমাদের কি মাঠে মেরে ফেলতে চাস?” ঠাঠানো স্বরে নিজের মেয়ের প্রতি চেঁচালেন ঝুমুর। ক্ষোভে চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে এসেছে তার। অসহ্যে রি রি করা বুকটা ওঠানামা করছে হাঁপরের মতো।
অথচ যাকে এসবকিছু বলে চলেছেন সে তার সম্মুখে সম্পূর্ণ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এতসময়ের এত কটুক্তি, এত কান ঝালাপালা করা চিৎকার-চেঁচামেচি যেন তাকে ছুঁতেই পারছে না।
আর তার এমন দায়সারাভাবটার জন্যেই রাগ সপ্ত আসমানে পাড়ি জমিয়েছে তার মা ঝুমুর আনসারীর।
মেয়েকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। সব হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে। যদি এমন চলতে থাকে তাহলে নির্ঘাত ওই ছোটলোকের কাছে মেয়ে খুইয়ে বসবেন তিনি।
অসম্ভব! এ কিছুতেই হয় না। তার এতদূর পড়াশুনা করা, ভালো চাকরি করা মেয়ে কিনা শেষ অব্দি এমন ডিভোর্সি ছেলে বিয়ে করবে! কখনো না। তিনি মরে গেলেও তা হতে দেবেন না।
দরকার হলে ওই ছোটলোকের বাচ্চাকে বিদেয় করবেন নিজের বাড়ি থেকে। এমনকি এই শহর থেকেও।
কত্তবড় সাহস! এ যেন বসতে দিলে শুতে চাওয়ার মতো অবস্থা!
নেহাতই দয়ালু মানুষ তিনি। যখন জেনেছিলেন ছেলেটার বউটা খুব সুচতুরভাবে সব টাকা পয়সা, সম্পত্তি নিজ নামে করে নিয়ে, স্বামী-সন্তান ফেলে পুরোনো প্রেমিককে বিয়ে করেছে, তখন খুব খারাপই লেগেছিল তার। রাতারাতি বাড়িঘর ছাড়া হয়ে গিয়েছিল এই ছেলেটা। একা হলে নাহয় সমস্যা ছিল না। কিন্তু আস্ত এই ঢাকা শহরটায় সাথে অসুস্থ মা আর ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে নিয়ে কোথায় যেতো সে!
পথ ছাড়া কোনো জায়গাই তো ছিল না। না ছিল তেমন টাকা পয়সা। সবটাই খুইয়েছিল।
তখন? সেই তখন তিনিই কি ওকে দয়া করে সল্পমূল্যে নিজের ফ্ল্যাটে জায়গা দেন নি? দিয়েছেন তো।
ঢাকা শহরে এই সাহায্যটুকুই বা কতোজন করে! অথচ তিনি করেছেন।
কিন্তু এই তার প্রতিদান!
ভালো পেয়ে এখন মেয়েকেও বাগিয়ে নিতে চাচ্ছে! এরপর বাড়িঘরও লুফে নেবে।
এখন তো মনে হচ্ছে এই রকম ছোটোলোকের সাথে ওর বউ যা করেছে ঠিকই করেছে।
অসভ্য, অভদ্র, ছোটোলোক!
“পাত্রপক্ষ কালই আসবে। খবরদার যদি কোনোরকমের হেরফের করেছিস! আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। কেউ না।” আঙুল তুলে শাসালেন ঝুমুর।
তবে সে শাসনে ছিটেফোঁটাও ভয় পেল না তোহরা৷ না ওর অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলো। দৃঢ়চিত্তে চেয়ে বলল, “আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।”
মেয়ের কথায় ফুসলে উঠলেন ঝুমুর।
বাজখাঁই গলায় হাঁক ছেড়ে আঙুল নেড়ে বললেন, “পারবি না মানে? তো কাকে বিয়ে করবি? ওই ডিভোর্সি ছেলেকে? মরে গেলেও তা হতে দেবো না আমি। যার সাথে আমি বলবো তাকেই বিয়ে করতে হবে তোর।”
“দুনিয়া উলটে গেলেও বিয়ে তো আমি ওকেই করবো মা। ও-কে-ই করবো।” জোর গলায় জানিয়ে দিলো তোহরা।
হুংকার দিয়ে উঠলেন ঝুমুর। চোখমুখ বিকট করে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “ওই ছোটোলোকের সাথে আমি কখনই তোর বিয়ে দেবো না। এত বড়ো সাহস! এত বড়ো সাহস ওর! কালই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ওদের বিদেয় করবো আমি। আমার খেয়ে আমাকেই ছুরি বসায়!”
কথাটা কর্ণধার হতেই শান্ত, নির্বিকার তোহরা যেন ভয়ানক তেঁতেঁ উঠলো। অনুপলেই শক্তপোক্ত মুখে জোড়ালো গলায় বলে উঠলো, “মুখ সামলে কথা বলো। ছোটোলোক কাকে বলছ তুমি? আর তোমার খেয়ে মানে? আমি খুব ভালো করেই জানি যে গুনে গুনে এখন সম্পূর্ণ ভাড়াটাই দেয় সে। প্রথম কয়েক মাসে তুমি যে এক-দু’হাজার কম নিয়েছ সেটার পুরোটাই পরে পুষিয়ে দিয়েছে সে।
তাও এত বড়ো বড়ো কথা বলো কোন সাহসে!
ওদের দিয়েছই তো আট তলার ফ্ল্যাটটা। কেন বলো তো? কারণ লিফট নেই তোমার এই আট তলার ফ্ল্যাটে। আর লিফট ছাড়া সবচেয়ে উপরের ফ্ল্যাট কেউ নিতে চাইতো না তোমার থেকে। পড়েই থাকতো ওটা। সেটাই দিয়েছ এজন্য। সেও নিয়েছে। শুধু প্রথমে ভাড়া দিতে খানিক হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে।”
মুখের উপর চটাস করে বলা সত্যগুলো গিলতে খুব কষ্ট হলো ঝুমুরের। আগুনে ঘি ঢালার মতো কথাটায় রাগে, অপমানে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। চেয়ে রইলেন বড়ো বড়ো রক্তিম বর্ণের চোখ মেলে।
তোহরা কথা বাড়ালো না। সোফা থেকে অফিসের ফাইলগুলো তুলে নিয়ে গটগট করে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।
ঝুমুর তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন রক্তচক্ষু নিয়ে।
সাত মাস আগের কথা।
দিনটা বুধবার। প্রতিদিনের মতো একটা চাঞ্চল্যকর দিনের শেষে পরিশ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো তোহরা। গাড়ি গ্রাউন্ড ফ্লোরে পার্ক করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঠেলে ঠেলে সিঁড়ির দিকে এগুলো ও।
মিরপুরের এই আট তলার বিল্ডিংয়ে তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। বাকিগুলো ভাড়াটিয়াদের জন্য।
প্রথমে এটা চার তলা ছিল। পরবর্তীতে আরো চার তলা করতে পেরেছেন তোহরার বাবা, নাথন আনসারী।
কিন্তু শুরুতে করা চারতলা ঠিকমতো পরিকল্পনা করে না বানানোর ফলে পরবর্তীতে লিফট বানানোর সুযোগই ছিল না আর।
তবে তোহার মাঝে মাঝে খুব রাগই হয় এতবড়ো ফ্ল্যাটটাতে লিফট নেই বলে। কাজ শেষে ফিরে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে কার-ই বা ভালো লাগে!
তার তো মোটেও লাগে না। তবুও উঠতে হয়।
এই যেমন আজও উঠতে হবে!
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল তোহরা। প্রতিদিনের ন্যায় আজও বেজার মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সিঁড়ির পানে।
অতঃপর মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে এক হাত রাখলো সিঁড়ির রেলিঙে আর অন্যহাত দেয়ালে৷ তারপর অতিশয় বিরক্ত মুখে ধীর পায়ে উঠতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে।
সাত আট সিঁড়ি পরে, ইউ টার্ন নেবার আগে থেমে দাঁড়ালো কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফের উঠতে লাগলো। এভাবে করে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির মাঝপথে এসে বিনা কারণেই দাঁড়িয়ে পড়লো ও। বিরসবদনে দেয়ালের দিকে রাখা হাতটায় মাথা হেলিয়ে দিলো চেয়ে রইলো বাকি সিঁড়িগুলোর দিকে।
বিনা কারণে বললে অবশ্য ভুল হবে। অতিরিক্ত ক্লান্তির করণেই বোধহয়। কিংবা সিঁড়িগুলোকে মনে মনে ভালোমন্দ গালি দেবার জন্য।
এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ই এভাবে দাঁড়িয়ে সিঁড়িগুলোর গুষ্টি উদ্ধার করে সে।
তিনতলাকে তিনশো তলা মনে হয় যে!
বুক চিড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হলো ওর। মাথা তুলে ফের পা বাড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই পুরুষালি ভারী আওয়াজে চমকে গেল।
“আপনি কি অসুস্থ?” কণ্ঠটা মৃদু তবে কিছুটা উৎকণ্ঠা মিশ্রিত।
চট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো তোহরা। বড়ো বড়ো চোখ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল সেই কণ্ঠস্বরের অধিপতিকে।
ঈষৎ গৌড়বর্ণ চেহারার বলিষ্ঠ দেহী এক ভদ্রলোক। পরণের কালো শার্টে