হিসাব জীবন থেকে নেওয়া

এতক্ষণে পৃথিবীতে সূর্যের আগমন ঘটেছে। সূর্যের মিষ্টি আলো জানালার সাদা পর্দা বেধ করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সাদা রঙটা আমার বেশ পছন্দের। তাইতো জুমাইমার আব্বুকে বলে ঘরের বেশিরভাগ জিনিস সাদা করে ফেলেছি। ছোটবেলায় আব্বু কখনো আমাকে সাদা পরতে দিতেন না। তিনি সবসময় বলতেন একটু গাঢ়ো রঙে নাকি আমাকে দারুণ লাগে। আব্বুর কথা শুনে আমি হাসতাম। তবে বরাবরের মতো সাদার প্রতিই আমার ঝোঁক ছিলো। কিন্তু সাহস করে কখনো বলতে পারিনি,
-আব্বু সাদা রঙটা আমার বেশ পছন্দের। এবারের ড্রেস গুলো আমার জন্য নাহয় সাদাই আনবেন।

বিয়ের আগে আব্বুর পছন্দই আমার এবং আপুমনির পছন্দ ছিলো৷ আব্বু ছিলো খুবই সৌখিন মানুষ। আম্মুর থেকেও আব্বুর আমাদের প্রতি নজর বেশি ছিলো। মেয়েরা কি খাচ্ছে, কি পরছে, পড়ালেখা কেমন করছে, রাতে ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে কি-না, নামাজ সময়মতো আদায় করছে কি-না, পর্দা ছাড়া বাহিরে বের হচ্ছে কি-না, নন-মাহরামের সামনে যাচ্ছে কি-না, সুন্দর ব্যবহার করছে কি-না এসব বিষয়ে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। সবসময় বলেন,
-মেয়ে মানেই জান্নাত! আমার ঘরে দু’জন জান্নাত আছে। আমি তাদের সঠিকভাবে লালনপালন করে সৎ পাত্রের সাথে বিয়ে দিলে আল্লাহ আমাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন ইনশাআল্লাহ। আমার মেয়েদের উপর অবিচার করলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না। হিসাব-নিকাশের দিন আমি তাঁর কাছে আসামি হিসেবে সাবস্ত হবো।
আব্বুর উপর আমরা খুব সন্তুষ্ট ছিলাম। তারপর আব্বু মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন,
-তোমরা কি আমার উপর সন্তুষ্ট?
আমরা একগাল হেসে বলতাম, না হয়ে উপায় আছে। আপনি যেভাবে আমাদের খেয়াল রাখছেন সেটা আর বলতে! আল্লাহ আপনাকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, আমীন।

আব্বুর মনটা ছিলো খুব নরম। আব্বু যখন আমাদের নাসীহা দিতেন তখন সবসময় একটা কথা বলতেন,
-নিজেকে সস্তা করবে না। নারী মানেই মুক্তো যদি সে পর্দার ভেতরে থাকে। রাস্তা দিয়ে চলার সময় খুবই কোমলভাবে হাটবে, যাতে করে রাস্তাও বুঝতে না পারে এখান দিয়ে একজন মানুষ হাটছে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে অন্য কারো কাছে নয় আমার কাছে চাইবে। আল্লাহকে স্মরণ রেখে কাজ করবে। মনে রাখবে কিয়ামতের দিন মহান রবের সামনে দাঁড়িয়ে এই কর্মের হিসাব দিতে হবে। কোনো খারাপ কাজে জড়ানোর আগে অন্তত তোমাদের এই অধম বাবার কথা মনে রাখবে। তোমরা কি চাও আমি আমাকে আগুনে পোড়ানো হোক? নিজে সর্বদা পর্দা আবৃত রাখার চেষ্টা করো। আর শুনো কখনো নামাজ যেনো ছুটে না যায়।

আব্বুর কথাগুলো আমাদের হৃদয় ছুয়ে দিতো। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করতো জড়িয়ে ধরে বলি,
-আপনি সত্যিই অনেক ভালো। আমরা আপনাকে ভালেবাসি।
তবে সেটা আর বলা হতো না। একেক সময় আব্বু খুব ইমোশনাল হয়ে বলতেন,
-রোজ কিয়ামতের দিন আমাকে মহান রবের কাঠগড়ায় দোষী করো না। আমি তোমাদের দু’বোনকে হাফেজা বানাতে পারিনি বলে। আল্লাহর কাছে আমার কোনো কিছু জবাব দেওয়ার থাকবে না। আমার প্রতি ইনসাফ করে নিজেদের পর্দায় রাখো। তোমাদের জন্য যেনো আমার আমলনামায় পাপ না উঠে সেদিকে খেয়াল রেখো।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের কোণটা ভিজে এলো। পেছন থেকে জুমাইমা এসে ঝাপটে ধরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল,
-আম্মি!
আমি পেছনে তাকিয়ে মৃদু হেসে কন্যাকে কোলে তুলে নিলাম। ওর বাবা যখন বাসায় থাকে না তখন আমার কথা মনে পড়ে। দাদাভাই মাদরাসা থেকে ফিরলে দৌঁড়ে গিয়ে হাত পেতে বলবে,
-আতনি কি আমাল জনন্য তকলেত এনেতেন?

এখনো ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না। নাতনীর কান্ড দেখে শ্বশুর আব্বুও না হেসে পারেন না। জুমাইমার হাতের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হলাম। কে দিলো এই আমটা? আমার মনে নানানরকম প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। জুমাইমা এটা চুরি করে আনেনি তো! আল্লাহ না করুক।

আমি নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
-আম্মি! তুমি এটা কোত্থেকে এনেছো? কে দিয়েছে তোমাকে এটা?

মেয়ে খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল,
-আমি এতা ওতান থেকে এনেতি। ওতানে পরে তিলো।

একটু রেগে গিয়ে বললাম,
-ওখান থেকে মানে? তুমি জানো অন্যের জিনিস না বলে ধরলে আল্লাহ গুনাহ দেন। তুমি কেন ধরেছো?

মেয়ে ছলছল চোখে বলল,
-আমি আল ধলবো না।

-সেটাতো ঠিক আছে তুমি আর ধরবে না। কিন্তু এবার কেন নিয়ে এসেছো? তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম না?

আমার কতা শুনে মামুনি পাশের রুম থেকে এগিয়ে এলেন। দাদুমনিকে দেখে জুমাইমা ঝাপটে গিয়ে ধরলো। মামুনি আমাকে শান্ত গলায় বলল,
-বউমা এবারের মতো ছেড়ে দাও না। ছোট মানুষ আনলে কি হবে? এতো বকাবকি না করলেই পারো।

মামুনির কথাটা আমার একদম পছন্দ হলো না। কেনো খারাপ কাজে প্রশ্রয় দিলে পরে সেটা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পায়। এজন্য শুরুতেই প্রশ্রয় না দিয়ে সেটা ধমিয়ে ফেলতে হয়। মনে মনে ভাবলাম এখন জুমাইমাকে প্রশ্রয় না দিলে সে আরো বড় কিছু করে বসবে। হতে পারে কারো বাসার জিনিসপত্র ছোঁয়াছুঁয়ি করবে। যেটা আমি মা হিসেবে সহ্য করতে পারবো না।

জানালা দিয়ে পাশের বাসার ভাবী পুরো ঘটনাটা দেখেছিলেন। মেয়ে তার দাদুমনির সাথে চলে যাওয়ার পর ভাবী আমাকে ডেকে বললেন,
-এটা কি করলেন ভাবী? জুমাইমা এখনও অনেক ছোট। ও হয়তো না বুঝেই এমনটা করেছে। তার জন্য এভাবে বকতে হবে?

-ভাবী মেয়েকে আমি ছোট থেকেই সঠিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। একজন বাচ্চাকে সৎ পথে পরিচালনা করার জন্য ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দিতে হয়। সে কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে এগুলো তো অবশ্যই চোখেচোখে রাখতে হয়। আমার মেয়ে আজ সামান্য আম নিয়ে এসেছে তাই বলে আমি এমন করছি কেন? আসলে ভাবী জুমাইমাকে এখন থেকে শিক্ষা না দিলে বড় হয়ে ভয়ানক কিছু করে ফেললে তখন কি হবে? সবাই তো আমার উপর দোষ চাপাবে।

-সেটা ঠিক আছে। কিন্তু জুমাইমা যে আম নিয়ে এলো সেটাতো কেউ দেখলো না। আর আমতো গাছ তলায় পড়েই থাকতো। জুমাইমা না আনলেও কেউ একজন আনতো।

-ভাবী মানুষ দেখলো না সেটা ঠিক। কিন্তু আসমানের মালিক তো দেখেছে! আম গাছ তলায় পড়ে থেকে পচে গেলেও আমার মেয়ে সেটা তোলার অধিকার রাখে না।

ভাবী চলে যাওয়ার পর আবারও আমি অতীতে হারিয়ে গেলাম। আমাদের ছোটবেলাটা খুবই সুন্দর ছিলো। এতো সুন্দর কারো ছোটবেলা হয় কি-না জানিনা। আমার আম্মুর থেকে ছোট ছোট নাসীহা গুলো পেতাম। যেগুলো সত্যিই অনেক অনেক বেশিই উপকারী ছিলো। আম্মু কোনো আলেমা ছিলেন না। তবে আলেমার থেকে কমও না! স্কুলে পড়েছিলেন। তবে হ্যাঁ আলেম বাবার প্রথমা কন্যা ছিলেন। বড়ই ভাগ্যবতী! তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী আলেম দিয়ে ভরা।

আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমরা যখন কারো গাছতলা ফল এবং কারো গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসতাম সেদিন আম্মু খুব রেগে যেতো। গাছের পাতা ছেঁড়া একদম নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। গাছতলা থেকে কুড়িয়ে আনা ফল আম্মু জীবনেও মুখে তুলতেন না। আমাদের দিয়ে সাথে সাথে প্রতিবেশীর বাসায় তাদের ফল পাঠিয়ে দিতেন।

মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো৷ কত কষ্ট করে সবার আগে নিয়ে এলাম। তবে আস্তে আস্তে সেটা বুঝতে শিখে গেছি। নানু বাড়িতে যাওয়ার পরও আমি এই দারুণ ব্যাপারটা দেখতাম। কারো জিনিস পড়ে থাকলে একটা ছোট বাচ্চাও সেটা না বলে নিবে না। ব্যাপারগুলো সত্যিই দারুণ লাগতো।

আমরা মাঝে মাঝে অভিমান করে বলতাম,
-এনেছি তো কি হয়েছে? কেউ তো দেখেনি।

আম্মু বেশ গরম হয়ে শাসিয়ে বলতেন,
-কেউ দেখেনি মানে! আল্লাহ তো দেখেছে। মনে রেখো এগুলোর হিসাব কিন্তু কিয়ামতের দিন হবে। সুতরাং কিছু করার আগে অবশ্যই ভেবেচিন্তে করবে।

আম্মু সবসময় সূরা হাশরের একটা আয়াত তেলাওয়াত করে আমাদের শুনাতেন৷ আয়াতটা আমার সবসময় মনে থাকলেও অর্থটা স্পষ্ট মনে থাকে।

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ لۡتَنۡظُرۡ نَفۡسٌ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدٍ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۸﴾

یایها الذین امنوا اتقوا الله و لتنظر نفس ما قدمت لغد ۚ و اتقوا الله ان الله خبیرۢ بما تعملون ﴿۱۸﴾

হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।
(৫৯ঃ১৮)

আম্মু সবসময় আরেকটা মূল্যবান কথা বলতেন,
-কারো গাছের একটু পাতাও যদি আমরা ছিঁড়ে আনি তবে রোজ কেয়ামতর ময়দানে সেটারও হিসাব দিতে হবে। এজন্য তোমাদের বলি, কারো কিছু ধরবে না। এমনকি একটা গাছের পাতাও না।
মনে রাখবে, তুমি গোপনে করলেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সেটা দেখছেন।

সত্যিই আমরা গোপনে অনেক কিছু করি। আমাদেরকে সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। আমরা আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের কি শেখাচ্ছি এবং তারা কি শিখছি। তাদের ভালো কিছু না শেখালে তাদের কর্মফলের অর্ধেক আমাদের উপর এসে পড়বে। গোপনে আমার বাচ্চা যদি কোনো গুনাহ করে তাহলে সেটার জন্য অবশ্যই আমি এবং আমি দায়ী। আমাকেই এটার জন্য হিসাব দিতে হবে। আবার আমি যদি কোনো পাপকর্মে লিপ্ত তাকি তাহলে সেটার জন্য আমার বাবা-মাকে হিসাব দিতে হবে।

এজন্য প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে আদর্শ শিক্ষা প্রদান করা। যাতে দুনিয়া ও আখিরাতে এর দ্বারা কল্যান হয়। প্রত্যেক মানুষকেই হিসাব দিতে হবে। সে কি শিক্ষা দিয়েছে আর কি শিক্ষা পেয়েছে।

মনে পড়ে গেলো আমার উস্তাযাহর বলা একটা নাসীহার কথা।
একজন বোন গোপনে হারাম রিলেশনে জড়িয়ে ছিলো৷ ভুলক্রমে সবাই সেটা জেনে যায়। একদিন উস্তাযাহ আমাদের সবাইকে নিয়ে বসে ছিলো নাসীহার ক্লাসে। আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে উনার সব কথাগুলো শুনছিলাম। তিনি বলেছিলো,

-আমাদের জীবন খুব ছোট। আমরা আজ আছি তো কাল নেই! অচিরেই আমাদের রবের নিকট ফিরে যেতে হবে। আমরা অনেকেই গোপনে কত কিছুর সাথে জরিয়ে আছি। আমরা হয়তো ভাবছি কেউ তো দেখলো না আরেকটু জড়ালে কি হয়? আগেই বলে রাখি পাপ করতে করতে মানুষের অন্তর মরে যায়। মানুষ তখন পাপে মজে যায়। সারাক্ষণ পাপে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এভাবে জড়িয়ে থাকলে হবে না! তোমার মনে হতে পারে এটা কেউ দেখছে না। আমাদের সকল কৃতকর্ম কিন্তু রেকর্ড হচ্ছে। আমরা কি কি করছি সব খাতায় লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। তবে মনে রেখো কুরআনে কারীমের একটা আয়াত৷ এই আয়াতটা তোমাকে পাপকর্ম থেকে দূরে রাখবে ইনশাআল্লাহ। তারপর উস্তাযাহ তেলাওয়াত করলেন,

اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا

(আল্লাহ বলবেন) তুমি তোমার কিতাব পাঠ করো;
আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।

আরো কিছু আয়াতের অর্থও বলেছিলেন,

کُلُّ شَیۡءٍ فَعَلُوۡهُ فِی الزُّبُرِ

আর তারা যা করেছে, সব কিছুই ‘আমলনামায়’
রয়েছে।
(সূরা আল ক্বামার, ৫৪ঃ৫২)
کُلُّ صَغِیۡرٍ وَّ کَبِیۡرٍ مُّسۡتَطَرٌ

আর ছোট বড় সব কিছুই লিখিত আছে।
(সূরা আল ক্বামার, ৫৪ঃ৫৩)

কত গুনাহ আমাদের জীবনে। আমরা হয়তো এটা ভেবে গুনাহ করছি যে, আমাদের কেউ দেখছে না। কিন্তু মহান রব কিন্তু আমাকে দেখছেন। আমার আমলনামায় কিন্তু সব উঠে যাচ্ছে। দুই কাঁধের ফেরেশতারা কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও থেমে নেই। তারা সব লিখে যাচ্ছেন। আমাদের মোটেও ভুলে যাওয়া উচিৎ না। সবসময় মনে রাখতে হবে হিসাবের দিনের কথা। যেদিন কারো হিসাব বাদ পড়বে না। সবাই নিজের কমকর্মের ফল পাবে যেটা সে গোপনে এবং সম্মুখে করেছে।

Related Posts

12 Comments

মন্তব্য করুন