বিবেক যখন কথা বলে

“চারদিকে আগুন, কোথাও এতটুকু ফাক নেই। ধাও ধাও করে জ্বলছে বাড়ি-ঘর, ফসল-ফলাদি। আগুনের তীব্রতায় জ্বলে যাচ্ছে সবকিছু। তার ঠিক উপরে মি. ফাহিম কোথায় যেন ঝুলে আছেন। অন্তিম চেষ্টা চালাচ্ছেন আগুন থেকে বাচার জন্য। কিন্তু তার হাত আর ধরে রাখতে পারছে না। শরীরের সম্পূর্ণ ভার যে তার হাতের উপর দিয়ে যাচ্ছে। এই বুঝি এক্ষুনি পড়ে যাচ্ছেন। এমন করতে করতে হঠাৎ পড়েই গেলেন”-

সাথে সাথে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। ভাবতে থাকলেন এ কোন স্বপ্ন দেখলাম। সারা শরীর ঘেমে একাকার। বিছানা থেকে নেমে টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেলেন। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন ৩ঃ১৯ বাজে। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লেন আর ভাবতে থাকলেন ” আমি এটা কি করলাম! এ কারণেই হয়তো কিছুদিন পর পর এমন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি। এটা না করলেও পারতাম। আমার তো টাকা-পয়সার অভাব ছিলো না।

কিসে আমায় এ অপরাধটা করতে বাধ্য করলো?” এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভি অন করে খবর দেখছেন। তিনি দেখলেন একজন রিক্সাচালক ৫০,০০০ টাকা কুড়িয়ে পেয়েছেন এবং সেই টাকা তার মালিককে দিতে পেরে অনাবিল আনন্দে হাসছেন। ফাহিম তা দেখে মনে করতে থাকলেন তার সুখের দিনগুলোর কথা। তিনিও একসময় মনের সুখে দিন কাটাতেন। কিন্তু এখন মাঝে মধ্যে হাসলেও মনের সুখটা থাকে না। প্রচলিত একটা কথা আছে “সুখে থাকলে ভূতে কিলায়” এমনটাই হয়েছে ফাহিমের সাথে।

যাইহোক, ডিউটির সময় হয়ে গেছে ফাহিমের, তাই থানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আজ তার স্ত্রী বাসায় নেই। কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। তাই নিজেকেই রান্না করতে হবে। ছেলেরা কি আর রান্নাবান্না করবে! তারা কি আর এ কাজের সাথে পরিচিত? কি আর করা, পরিচিত না হলেও করতেই হবে। ফ্রিজ থেকে একটা ডিম বের করে কড়াইতে ঢেলে দিলেন। আর মনে মনে ভাবতে থাকলো, আর কোনো কাজে না লাগোক রান্নার কাজে বউকে বিশেষভাবে প্রয়োজন। বউ না থাকলে বোঝা যায় ছেলেদের কি কষ্ট। এসব ভাবতে ভাবতে ডিম ভাজি প্রস্তুত হয়ে গেলো। কোনোরকম খেয়ে-ধেয়ে ডিউটিতে চলে গেলেন।

এবার আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই ফাহিম লোকটার সাথে। তিনি এখন ঢাকা তেজগাঁও থানার ওসি পদে চাকরি করেন। দু’বছর আগে এখানে বদলি হয়েছেন। দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। বাড়িতে মা এবং দুই বোন আছেন। ছোটবেলা থেকেই ফাহিম একজন নীতিবান সৎ লোক। গ্রামের সবাই তাকে পছন্দ করে। তখন থেকেই স্বপ্ন, বড় হয়ে পুলিশের চাকরি করার। সে স্বপ্ন এখন সত্যি হলো।

চাকরির প্রথমদিন থেকেই সবার নজর কাড়তে পেরেছিলেন তিনি। নিজের কাজের প্রতি যেমন দায়িত্বশীল তেমনি সৎ।দু’বছর যাবৎ তেজগাও থানায় আছেন। এ দু’বছর নিষ্ঠার সাথে নিজের ডিউটি পালন করে গেছেন। কারো কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া বা অনৈতিকভাবে কাউকেই কোনো বিশেষ সুযোগ দেননি। তিনি নিজের দায়িত্বটাকেই সবার উপরে রেখেছেন। কিন্তু হঠাৎ………..?

একদিন উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান তার থানায় আসলেন। তিনি এসেছেন তার ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে। কিছুদিন আগে ওনার ছেলে এক খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। এক লোককে খুন করে এখন একজন অপরাধী। চেয়ারম্যানের চোখে ঘুম নেই। ছেলেকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় সেই চিন্তাই তিনি করেন। এজন্যেই তিনি থানায় এসেছেন।

– ভালো আছেন ওসি সাহেব?
– আরে চেয়ারম্যান আপনি এ সময়, আসুন আসুন বসুন।
– কেমন আছেন?
– ভালো থাকবো কি করে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেল, ভালো থাকা যায়?
– হুম ঠিক বলেছেন, আসলে এ বয়সের ছেলেদের একটু চোখে চোখে রাখা প্রয়োজন। আপনার ছেলে যেভাবে খুনটা করেছে যেকোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকেই হার মানিয়ে দেবে। প্রচুর বুদ্ধি খরচা করেছে ও। কিন্তু আমরাও কম যাইনি। খুনটা ও-ই করেছে তার অনেক প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। আপনার ছেলেকে আর বাচানো সম্ভব নয়।

– আমিও জানি খুনটা ও-ই করেছে। শুনলাম ওকে ধরতে আপনারা উঠেপড়ে লেগেছেন?
– আমাদের কাজ-ই তো এটা। যেখানে অন্যায় দেখবো সেখানেই পুলিশ থাকবে, ঠিক না?
– সারাজীবন ঠিক থাকলেও আজকের জন্য এটা ঠিক না।
– মানে?
– এখানে ৫ লক্ষ আছে। লাগলে আরো দেবো।
কেসটা মিটমাট হওয়া চাই।
– আপনি আমাকে ঘুষ দিচ্ছেন? আপনি ভালো করেই জানেন আমি অন্যায় কোনো কিছুই করি না।

– অন্যায় কী হচ্ছে? আমিতো এর দাম দিচ্ছি। ভেবে নেন অন্যায়টা কিনে নিচ্ছি। আপনি সৎ অফিসার এই দু একবার অন্যায় করলে তা দেখা যাবে না।
ফাহিম কি করবে বুজতে পারছে না। ভাবছে, ঠিক ই তো দু একবার পাপ করলে সেটা হিসেবে উঠবে না। তাছাড়া সামান্য কাজের বিনিময়ে ৫ লক্ষ টাকা! অবশেষে টাকাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়েই নিলেন।
এরপর থেকেই ফাহিম কোনো কাজেই স্বস্থি পাচ্ছেন না। তার মধ্যে অশান্তি কাজ করছে।
কিছুদিন পরপর ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখেন। তার চোখ পাপ করলেও বিবেক তা মেনে নিতে পারেনি। এভাবেই তিনি দিনের পর দিন বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে রইলেন।

……… ইমন……..
কটিয়াদি, কিশোরগঞ্জ

Related Posts

11 Comments

মন্তব্য করুন