ভাই বোনের সম্পর্ক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক

রাত বাজে 10.30
হঠাৎ আমার ফোন টা বেজে উঠলো। ফোন তুলে দেখলাম আমার ছোট বোন সুমি কল করেছে। ফোনটা ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে সুমি বলে উঠলো আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা ভাইয়া আমি আর পারছিনা এই নরকে থাকতে। কিন্তু আমি স্বার্থপরের মতো বললাম সমস্যা তো তোর মধ্যেই আছে। অযথা তোর স্বামীর দোষ দেওয়াও তো ঠিক না। কারণ সে তো পুরো চার বছর অপেক্ষা করলো যদি তোর কোনো বাচ্চা হয় কিন্তু তো ওকে কোনো বাচ্চা দিতে পারলিনা। আর সবার মতো তোর স্বামীর ও তো ইচ্ছা করে বাবা হতে, বাবা ডাক শুনতে। যাই হয়ে যাক তোকে ওখানেই থাকতে হবে। নিজের স্বামীর থেকে আপন পৃথিবীতে আর কেউ হয় না। আমার কথা শুনে সুমি ফোনটা কেটে দিলো

সেদিন থেকে আজ প্রায় ছয়টা বছর পেরিয়ে গেল সুমি একদিনও আমাকে কল করে নি। আমি ও আর ওর খোঁজ নাওয়ার প্রয়োজন মনে করি নি। সুমির বিয়ে হওয়ার চার বছর হওয়ার পরে ও সুমির কোনো বাচ্চা হচ্ছিলোনা তাই সুমির স্বামী অন্য একটা বিয়ে করে সেখান তার বাচ্চা ও হয়েছে। কিন্তু সুমির বাচ্চা হয় না বলে ওর স্বামী সহ শশুর শাশুড়ি ওকে অনেক অত্যাচার করে নির্যাতন করে। সেই নির্যাতন থেকে বছর জন্যই হয়তো সেদিন সুমি আমাকে ফোন দিয়েছিলো কিন্তু আমি কি করতাম আমিও যে নিরুপায়।

ছয় বছর পরে আমি অফিসের এক বড়ো ভাইয়ের কাছে এক হাজার টাকা ধার করে নিয়ে কিছু দই আর মিষ্টি কিনে সুমি কে দেখতে গেলাম। দরজার সামনে দাঁড়াতেই ওই শাশুড়ি বলে উঠলো এত সস্তার মিষ্টি আমরা খাই না। যাওয়ার সময় সেগুলো জানো ফিরিয়ে নিয়ে যাই। এত বেশি খারাপ লেগেছিলো সেদিন মনে হচ্ছিলো মাটির সাথে মিশে যাই।
সুমির শাশুড়িকে বললাম সুমি কথা ওকে একটু দেখে দিন ওর সাথে একটু কথা বলেই চলে যাবো। সুমির শাশুড়ি চোখে মুখে অনেক বিরক্তির একটা ছাপ নিয়ে সুমি কে ডাকলেন।

একই অবস্থা আমার বোন সুমির। সুমি তো এমন ছিল না। ঠিক মতো খেতেও দেয় না ওকে। পরনে একটা ছেড়া শাড়ি। পায়ে নেই কোনো সেন্ডেল। ঠিক মতো যেন হাঁটতেও পারছেনা। পায়ের নিচের দিকে অনেক টা কাটার দাগ এখনো শুকায় নি।

হঠাৎ সুমি বললো কেমন আছো ভাইয়া? এসো ভিতরে এসো। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবো এমন সময় একজন মহিলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ওনার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা দেখেই মনে হলো উনি চায় না আমি ভিতরে যাই। বেরিয়ে আসলাম তখনি।

সুমি আমাকে এগিয়ে দিতে বড়ো রাস্তার মোর পর্যুন্ত আসলো। ঠিক মতো হাঁটতে পারছেনা বলে জিগ্যেস করলাম পায়ে কি হয়েছে। বললো আমার সতীন বটি ছুড়ে মেরেছিলো ওনার বাচ্চার দুধ গরম করতে দেরি হয়েছিল বলে। তাই বলে বটি।
হ্যা এ আবার নতুন কি গরম পানি গায়ে ঢেলে দেওয়া, বটি ছুড়ে মারা, মুখে গরম চা ঢেলে দাওয়া এগুলা এ বাড়ির রোজকার ঘটনা। তুই চিন্তা করিস না এগুলা আমি এখন মেনে নিতে শিখে গেছি। বলেই আঁচলের গিট খুলে কিছু পুরোনো নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো মিষ্টি গুলো তো ধার করে এনেছিস নে এখানেই তিনশো টাকার মতো আছে কষ্ট করে চালিয়ে নিস্ বলে আমি কিছু বলার আগেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসার দিকে চলে গেল সুমি।

অনেক খারাপ লেগেছিলো সেদিন সুমি কে দেখে তাই বাসায় ফিরে আমার স্ত্রী সালেহা কে বললাম সুমি ওর শশুর বাড়িতে অনেক কষ্টে আছে কিছুদিনের জন্য ওকে আমাদের এখানেই নিয়ে আসি ওর মনটা একটু ভালো হবে।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সালেহা চোখ মুখ অন্ধকার করে বললো রোজগার করো তো সেই ছহাজার টাকা তাই দিয়ে আমাদের তিন ছেলে মেয়ের প্রয়োজন ঠিক মতো মিটাতে পারো না আবার আর একজনের ভার। এদিকে তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি আছে বাড়িওয়ালা দিনে দুবার করে বলে যাচ্ছে এই মাসের মধ্যে ভাড়া মিটাতে না পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে সেদিকে কোনো খেয়াল আছে।এদিকে কতগুলো টাকা দেনা হয়ে আছে সেগুলা কি মনে নাই তোমার।
আরেকজন এসে ঘাড়ের উপর বসে বসে গিলবে তার ভার কে নেবে শুনি।দেনা কদিন পরে নাহয় মিটাবো আর এ মাসের মধ্যে বাড়ি ভাড়া ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। আর আমার ভাগে যেই খাবার টা থাকবে সেটা নাহয় আমি আর সুমি ভাগ করে খেয়ে নেবো।
এই কথা শুনেই সালেহা মুখ ভার করে রান্না ঘরে চলে গেল। বুঝতে পারলাম আমি সুমির জন্য কিছুই করতে পারবোনা।

সেদিন থেকেই সুমির কথা আর মনে করতে চাই নি। নিজের মতো কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ একদিন বাসায় দিরে দেখলাম আমার বড়ো ছেলে এস এস সি তে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে। এখন ওকে একটা ভালো কলেজ এ ভর্তি করতে হবে আর মাত্র তিন দিন বাকি। ভর্তি করতে লাগবে এগারো হাজার টাকা। এত টাকা আমি কোথায় পাবো দিশেহারা হয়ে যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলাম তখনি হঠাৎ মনে পড়লো ভুলে যাওয়া সেই সুমির কথা। সাথে সাথে সুমি কে কল দিলাম সব সমস্যার কথা বললে সুমি টাকা দিতে রাজি হলো। কিন্তু সুমি আমাকে ওদের বাসায় যেতে নিষেধ করলো বললো বড়ো রাস্তার মোরে ওর জন্য অপেক্ষা করতে।

ওদের বাসায় যেতে হবেনা শুনে আমিও একটু শান্তি পেলাম নাহলে আবার অনেকগুলো টাকা খরচ করে মিষ্টি কিনে যেতে হতো কিন্তু বোনের সাথে দেখা করতে যাবো একদম খালি হাতে যেতে ইচ্ছা করছেনা বলে রাস্তায় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি ছোট বোন টার জন্য কি নিয়ে গেলে ও অনেক খুশি হবে।
হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা দোকানে দেখতে পেলাম একজন দোকানি নুপুর বিক্রি করছে।

সুমি ছোট বেলায় নুপুর অনেক ভালোবাসতো। তাই বাবা ওকে প্রতি মাসে নুপুর কিনে দিতো।
তেমনি করে আমিও সুমির জন্য সস্তায় একজোড়া নুপুর নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গেলাম।

সুমি আমাকে পুরো বারো হাজার টাকা দিলো। কিন্তু সে টাকা ও কোথায় পেয়েছে সে বিষয়ে আমাকে কিছু বললো না।
কিন্তু সেদিন ও আমার দেওয়া নুপুর দেখে অনেক বেশি খুশি হয়েছিল যতটা খুশি ও বাবা নুপুর কিনে দেওয়ার পরে হতো। ওর আনন্দ দেখে মনটা জানো আমার ভোরে গেল।

সেদিনের ঠিক দু দিন পরেই হঠাৎ সুমির স্বামীর নাম্বার থাকে কল আসলো আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে চিৎকার করে বললো এখনই এসে চোর বোন কে নিয়ে যান আমার বাড়িতে ওর আর কোনো জায়গায় নেই বলেই ফোন টা কেটে দিলো।
সাথে সাথে আমি সুমির শশুর বাড়িতে গেলাম। সুমি কে মারতে মারতে আর কিছুই বাকি রাখে কি ওর শশুর বাড়ির লোকজন।
হঠাৎ সুমির স্বামী বলে উঠলেন কেমন ভাইয়া আপনি বোন কে শশুর বাড়ি থেকে চুরি করতে পাঠান। আপনার মতো ভাইয়া থাকার থেকে তো না থাকাই ভালো। আপনি এই মুহূর্তে আপনার বোন কে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যান ওর  এইবাড়িতে আর কোনো জায়গায় নেই। অসহায়ের মতো আমি সুমির স্বামীর পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম আর যাই করেন আমি আপনাকে আপনাদের সব টাকা ফিরিয়ে দিবো কিন্তু আমার বোন তাকে তাড়িয়ে দিয়েব না। ওকে আপনাদের কাছে আশ্রয় দিন। কিন্তু আমার কথায় কোনো কাজ হলো না। একসময় সুমি স্বামী সুমিকে তিন তালাক দিয়ে দিলেন।

দ্বিতীয় বারের মতো সুমি সেদিন আমাকে বলেছিলো ভাইয়া আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা আমি এখানে আর থাকতে পারবোনা। কিন্তু তারপরও আমি বার বার ওদের কাছে মিনতি করেছি আমার বোন তাকে ঠাই দিতে কিন্তু ওদের পাষান মন আর গলেনি।

অবশেষে আমি সুমি কে নিয়ে বেরিয়ে এসে একটা রেল লাইনের ধরে বসে গল্প করছিলাম। সুমি বললো ভাইয়া আমি একটা কাজ করতে চাই তুই আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দিবি।
কিন্তু এই ব্যাস্ত শহরে আমি নিজেই একজন ভুক্তভুগি সেখানে আমি সুমি কে কি কাজ জোগাড় করে দেবো ভাবতে ভাবতে সুমি বললো ভাইয়া আমাকে খুব খিদে পেয়েছে।
পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা দশ টাকার নোট।
দশ টাকা দিয়ে একটা পাউরুটি কিনে সেই ছোট বেলার মতো করে দুজনে ভাগা ভাগি করে খেলাম। দুজনে গল্প করতে করতে দেখি সুমি ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আমি সুমি কে নিয়ে কোথায় যাবো কি করবো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সালেহার ফোন।

তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি থাকায় বাড়িওয়ালা ওদের বাসা থেকে বের করে দিয়েছে ওরা এখন ওর বাবার বাসায় উঠেছে।
কিন্তু সেখানে গিয়ে ওদের ছোট মেয়ে টা বাথরুম এ পরে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে এখন ওকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।

যাওয়ার আগে ছোট একটা কাগজে লিখে দিলাম হঠাৎ করে তো তালাক হয় না তুই আবার ফিরে যা বোন।
আর পারলে এই হতভাগা ভাইয়া টাকে ক্ষমা করে দিস। বলে আমি সেখানে থেকে চলে আসলাম।

আমার ছোট মেয়ে কে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে আমি রাস্তায় হেটে যাচ্ছি অনেক টাকার দরকার টাকা জোগাড় করতে হঠাৎ সবার মুখে শুনি রেল লাইনে কাঁটা পরে একজন মহিলা মারা গেছে। মুখ সহ সারা শরীর এমন ভাবে থেতলে গেছে যে চেনার উপায় নেই। হঠাৎ আমার মনে জানো পাথর ভেঙে পড়লো।
আমি দৌড়ে চোলে গেলাম রেল লাইনের ধরে। ততক্ষনে সেখানে পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা বাদ শুরু করেছে।
আমি কোনোরম ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে দেখি সত্যি এমন ভাবে সারা শরীর থেতলে গেছে যে উনি কে তা চেনার উপায় নেই।
তখনো আমি মনে মনে বিস্বাস করছিলাম উনি আমার ছোট বোন সুমি হতেই পারে না। আমার বোন আবার ফিরে গেছে ওর শশুর বাড়িতে।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ পড়লো সেই মৃতদেহটার পায়ের দিয়ে ওনার দুই পায়ে পড়া ছিল রং চোটে যাওয়া একজোড়া নুপুর ঠিক সেই নুপুর যেই নুপুর আমি আমার বোন কে কিনে দিয়েছিলাম। অনেক সস্তার তাই রং উঠে নষ্ট হয়ে গেছে।

একজন পুলিশ এসে আমাকে জিগ্যেস করলেন আপনি কি ওনাকে চিনেন আমি বললাম আমার এক সময়ের অনেক কাছের অনেক পরিচিত একজন। কিন্তু এখন অনেক দূরের কেউ।

আমার কথা শুনে পুলিশ আমাকে ধমক দিয়ে বললেন আপনি একটা পাগল। সবাই আমাকে পাগল পাগল বলে উপহাস করতে লাগলেন।

মুখ থুবড়ে মাটিতে পরে সত্যি আমারো মনে হচ্ছিলো আমি আসলেই একজন পাগল।

Related Posts

14 Comments

মন্তব্য করুন