ভালো ঘুম হওয়ার কার্যকরী কিছু কৌশল

কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। কিন্তু আজকেও রাত ২ টা পেরিয়ে গেলো তবুও ঘুম আসছে না। উহ! রোজ রোজ এসব আর ভালো লাগে না কি যে করি…

কি আপনার সাথেও কি এমনটাই হয়? আজকাল আমরা অনেকেই এই বাজে অভিজ্ঞতার শিকার। রাতে একটা ভালো ঘুম দিয়ে সকালে ফ্রেশ মাইন্ড নিয়ে ঘুম থেকে উঠার মজায় আলাদা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় এখনকার সময় আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই ঘুমের ঘাটতি দেখা যায়। আর এই ঘুম সল্পতার জন্য শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আমদের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বললেই চলে। নানা ধরনের রোগে ভুগতে হচ্ছে যেমনঃ স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বিষণ্ণতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস সহ আরো অনেক ধরনের রোগ ও মানসিক চাপে ভুগতে হচ্ছে আমাদেরকে।

তাহলে এসব সমস্যার সমাধান কি? হ্যাঁ সেই বিষয়গুলি নিয়েই আজ আমরা জানবো যে কিভাবে আপনি সঠিক ভাবে ও সঠিক উপায়ে ঘুমানোর মাধ্যমে এসব সমস্যা থেকে একশ হাত দূরে থাকবেন। তাহলে চলুন জেনে নিই এই সমস্যা গুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

ঘুম আসলে কি? ঘুম কেন এতটা জরুরী?

ঘুমের সংজ্ঞা জীবনের মতই অসম্পূর্ণ। কেউই এখনো সঠিকভাবে একে বুঝে উঠতে পারেনি। সাধারনভাবে বলা যায় ঘুম হলো এক প্রকার প্রাকৃতিক পর্যায়ক্রমিক বিশ্রাম অবস্থা যখন চোখ বন্ধ থাকে আর চেতনা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে হারিয়ে যায়, যার ফলে বাহ্যিক কোনো উদ্দীপনার প্রতি শরীরের সাড়া প্রদানের প্রক্রিয়া কম থাকে।

যখন আমরা জেগে থাকি তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় ক্যাটাবলিক স্টেট (Catabolic State)। এই অবস্থাতে আমাদের শরীরের এনার্জি খরচ হতে থাকে। আর যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখন সেই অবস্থাকে বলে অ্যানাবলিক স্টেট (Anabolic State)। এই অবস্থায় আমাদের শরীর এনার্জি সংগ্রহ করতে থাকে। ভালো ঘুম আমদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শারীরিক বিপাকীয় ক্রিয়া ঠিক রাখে, হরমোনের ভারসাম্যতা ঠিক রাখে, দৈহিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়া গুলোকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এজন্য ঘুম আমাদের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত জরুরী।

ভালো ঘুমের জন্য কোনটি প্রয়োজন আলো নাকি অন্ধকার?

ভালো ঘুমের জন্য সবচেয়ে জরুরী জিনিস হলো দেহে মেলাটোনিন (Melatonin) নামক এক প্রকার হরমোনের স্বাভাবিকভাবে ক্ষরণ হওয়া। মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্ল্যান্ড (Peneal Gland) থেকে মেলাটোনিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনটি আমাদের শরীরের ঘুমের চক্রকে বজায় রাখতে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। মেলাটোনিন হরমোন শুধু অন্ধকার হলেই মুক্ত হতে শুরু করে। দিনে যত বেশি সম্ভব আলোর মধ্যে থাকার চেষ্টা করুন এবং রাতে ঘুমের এক ঘণ্টা পূর্ব থেকেই সকল প্রকার আলোর উৎস থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। তাহলে মেলাটোনিন হরমোনটি সঠিকভাবে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে সক্ষম হবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার ঘুম চলে আসবে।

ঘুমানোর কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে থেকে আপনি আলো সৃষ্টি করে এমন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যেমনঃ টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি ডিভাইস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এসব ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস গুলোর ক্ষতিকর ব্লু লাইট মেলাটোনিন হরমোন ক্ষরণে সরাসরি বাধা সৃষ্টি করে। যার জন্য ঘুম আসতে চাইনা বললেই চলে। আর যদি কোনো কারণে ঘুমানোর সময় আলো বন্ধ করা সম্ভব না হয় তবে আপনি আইমাস্ক (Eye Mask) ব্যবহার করতে পারেন। তবে সবসময় চেষ্টা করুন ঘুমানোর সময় রুমটি সম্পূর্ণ অন্ধকার করে রাখতে। তাহলে বুজতেই পারছেন ভালো ঘুমের জন্য অন্ধকার কতটা প্রয়োজনীয়।

শারীরিক পরিশ্রম

ভালো ও গভীর ঘুমের জন্য শারীরিক পরিশ্রম খুবই জরুরী ও কার্যকরী। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যেদিন আমরা খুব ক্লান্ত থাকি সেদিন খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ঘুম চলে আসে। কিন্তু যেদিন আমরা কম ক্লান্ত অনুভব করি সেদিন আমাদের ঘুমাতে কষ্ট হয়ে যায়। এর কারণ কি? কেন এমন হয়? আমরা যখন পরিশ্রম করি তখন আমদের মস্তিষ্কে অ্যাডিনোসিন (Adenosine) নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ জমা হতে থাকে যাকে ঘুমের প্রসার তৈরি করার রাসায়নিক পদার্থ বলা হয়। এই রাসায়নিক পদার্থটি আমাদের চোখে ঘুম এনে দেয়। কিন্তু আপনি যদি কম পরিশ্রম করেন তাহলে আপনার শরীরে পর্যাপ্ত এনার্জি খরচ না হওয়ার কারণে সহজে ঘুম আসতে না।

এজন্য প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রম করা প্রয়োজন। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে দ্রুত ঘুমের জন্য আপনি ঘুমের তিন ঘণ্টা পূর্বে কিছু ব্যায়াম করতে পারেন তাহলে তা আপনার ঘুমের মান ভালো করতে সহায়তা করবে। এছাড়াও আপনি নিয়মিত খেলাধুলা, ব্যায়াম করা সহ বিভিন্ন শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেন যা আপনার ভালো ঘুমের জন্য খুবই কার্যকরী।

আরামদায়ক বিছানা

কিছু বিছানা আছে যেখানে শোয়ার সাথে সাথে চোখে ঘুম চলে আসে। আবার এমনও কিছু বিছানা আছে যেখানে শত চেষ্টা করলেও ভালো ভাবে ঘুমানো সম্ভব হয় না। কারণ আমাদের শরীর যেখানে আরাম অনুভব করে সেখানেই সে ঘুমিয়ে পড়ার সংকেত দেয়। আবার যেখানে অস্বস্তি অনুভব সেখানে সহজে ঘুমের সংকেত দেয় না। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের 2011 সালের এক রিসার্স থেকে জানা যায় 92% মানুষ বলেছে ভালো ঘুম ও মন্দ ঘুমের জন্য দায়ী হলো তাদের বিছানা। এজন্য ভালো ঘুমের জন্য আরামদায়ক একটি বিছানার প্রয়োজন রয়েছে।

রুমের তাপমাত্রা

আমরা যখন ঘুমায় তখন আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। এজন্য ঘুমানোর পূর্বে আমরা যদি রুমের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে পারি তাহলে শরীর আরাম অনুভব করে। আমাদের শরীর ত্বকের সাহায্যে তাপমাত্রা অনুভব করে। যখন ত্বক আরামদায়ক তাপমাত্রা পায় তখন সে মস্তিষ্ককে ঘুমের সংকেত দেয়। খুব গরম এবং অতিরিক্ত শীত দুটোই আমাদের ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে। এজন্য ঘুমানোর পূর্বে রুমের তাপমাত্রা আরামদায়ক থাকলে ঘুম ভালো হয়।

দুশ্চিন্তা দূর করুন

ভালো ঘুমের আরেকটি প্রধান শত্রু হলো দুশ্চিন্তা। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে আপনার ঘুমের বারোটা বাজবেই। এজন্য দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে আপনি কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। পদ্ধতি গুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।

পদ্ধতি-1: (Breathing System) প্রথমে আপনি আরাম মতো বিছানায় বসুন। তারপর চোখ বন্ধ করুন। এরপর ধীরে ধীরে 4-5 সেকেন্ড ধরে নাক দিয়ে শ্বাস নিন। এরপর 7 সেকেন্ড সেই শ্বাস ধরে রাখুন। তারপর 7-8 সেকেন্ড ধরে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে সেই শ্বাস ছাড়ুন। এভাবে 5-10 মিনিট এই প্রক্রিয়াটি করতে থাকুন। এটা আপনার হৃৎপিণ্ডকে স্বাভাবিক করে দিবে এবং মস্তিষ্ককে শান্ত করে আপনার চোখে ঘুম এনে দিবে।

পদ্ধতি-2: সাইকোলজিক্যাল রিসার্স অনুযায়ী কোনো দুশ্চিন্তা যখন আমাদের ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে তখন আমরা যদি সেই বিষয় গুলো কাগজে লিখে ফেলি এবং সেগুলোর কাল্পনিক সমাধান বের করে মনকে সন্তুষ্ট করতে পারি তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে যায় এবং তারপর ঘুম আসতে সাহায্য করে। এজন্য ঘুমানোর প্রায় দুই ঘণ্টা পূর্বেই সকল ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এবং সে কাজের চিন্তা গুলোকে গুছিয়ে একটি কাগজে লিখে ফেলতে হবে। আর সম্ভব হলে সমস্যা গুলোর সমাধানও লিখে ফেলতে হবে।

পদ্ধতি-3: বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যারা কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ির সময় দেখে আর ঘুম থেকে উঠার কথা চিন্তা করতে থাকে তারা সহজে ঘুমাতে পারে না। তারা সবসময় দুশ্চিন্তাই থাকে যে তাদের ঠিক এতো সময়ের মধ্যে ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে। তাই কিছুক্ষণ পর পর তাদের মনে হয়, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি এখনো ঘুম আসলো না! এভাবে সারারাত কেটে যায় তাদের। এজন্য আপনাকে অ্যালার্ম ছাড়া ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করতে হবে। তাহলেই আপনি দুশ্চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন।

ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলুন

ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। আর যদি আপনার স্নায়ুতন্ত্র গুলো পরিপূর্ণ ভাবে সক্রিয় থাকে তাহলে ঘুম আপনার চোখে সহজে ধরা দেবে না। এজন্য বিকাল 4 টার পর থেকে চা ও কফি জাতীয় পানীয় গুলো এড়িয়ে চলুন। এর ফলে আপনার শরীর ঘুমানোর পূর্বে কিছুটা সময় পাবে এগুলো শরীর থেকে বের করার।

সঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া

গবেষণা থেকে জানা গেছে মানব শরীরের সবচেয়ে ভালো রিকভারি হরমোন গুলো ক্ষরিত হয় রাত 10 টা থেকে রাত 2 টা পর্যন্ত ঘুমানোর সময়। বাড়তি সময়টুকু আপনি যতটা ঘুমান সেটা আপনার শরীরের জন্য বোনাস। ডক্টর এরিক বার্গ এর মতে আমাদের প্রতিদিন 10:30 থেকে 10:45 এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া উচিত। কারণ এই সময়টুকুই আমাদের শরীরের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ঘুমের সময়। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে আমরা যদি সুস্থ থাকতে চায় তাহলে আমাদের প্রতিদিন কমপক্ষে 7-9 ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। কমপক্ষে 7-8 ঘণ্টার কম ঘুম হলে আমাদের ঘুমের ঘাটতি থেকে যায়। যার ফলে সারাদিন আমাদের চোখে মুখে ঘুমভাব লেগে থাকে। এজন্য প্রতিদিন একটি রুটিন মোতাবেক সঠিক সময় মতো ঘুমনো প্রয়োজন।

সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা

শুরুতেই বলেছি যে, রাতে একটা ভালো ঘুম দেয়ার পর সকালে ফ্রেশ মাইন্ড নিয়ে উঠার মজাটাই অন্যরকম। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রকৃতির হাওয়া গায়ে লাগানোর চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও কিছুদিন পর থেকে দেখবেন এটা আপনার একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটা শরীর ও মন দুটোর জন্যই বেশ ভালো। এজন্য চেষ্টা করুন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার। এতে আপনার শারীরিক ও মানসিক দিক প্রফুল্ল থাকবে। এবং একটা সময় দেখবেন যে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার জন্য আপনি রাতে সঠিক সময়েই ঘুমিয়ে পড়বেন। তখন আর বেশি রাত জাগার ইচ্ছা কাজ করবে না।

প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়

  • ঘুমের প্রায় দুই ঘণ্টা পূর্বেই রাতের খাবার শেষ করতে হবে।
  • রাতে পরিমিত খাবার গ্রহণ করতে হবে। একেবারে বেশিও না আবার খুব কমও না। স্বাভাবিক ভাবে পরিমিত পরিমাণে খাবার গ্রহণ করুন। আবার না খেয়েও কিন্তু ঘুমানো যাবে না।
  • রাতে পানি কম পান করার চেষ্টা করতে হবে।
  • ঘুমের পূর্বে চিনি, মসলা ও চর্বি জাতীয় খাদ্য বর্জন করতে হবে।
  • বিকাল 4 টার পর থেকেই ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল জাতীয় খাদ্য বর্জন করতে হবে।
  • দুপুরে অধিক পরিমাণে ঘুমানো বর্জন করতে হবে।

এই বিষয় গুলো আপনাকে এজন্য মানতে হবে কারণ এগুলো আপনাকে সহজে ঘুমাতে দেবে না। নয়তো আপানর ঘুমের বাধা সৃষ্টি করবে। এজন্য ঘুমানোর পূর্বে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন।

এতক্ষণ আমরা জানলাম ভালো ঘুমের জন্য কি কি বিষয় আমাদের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে অনেকেরই ঘুমের সমস্যা দেখা যায়। যাদের এ সমস্যায় ভুগতে হয় তারা যদি উপরের বিষয় গুলো সঠিক ভাবে মেনে চলতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার সমস্যাটি অনেকাংশেই সমাধান হয়েছে। উপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি বিষয়গুলো প্রথম থেকেই সবকিছু একসাথে মেনে চলা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা ধীরে ধীরে এই বিষয় গুলো যদি অভ্যাসে পরিণত করতে পারি তাহলে ঘুমের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

আর্টিকেলটি কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে জানান। আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দিন। ধন্যবাদ।

Related Posts

17 Comments

মন্তব্য করুন