‚“কাশফুলে মাঠটা ছেঁয়ে গেছে একেবারে।কাশফুলগুলোর উপর দিয়ে ফড়িং উড়ছে।কি সুন্দর সুন্দর ফড়িং।ধরতে গেলেই উড়ে যায়।ধ্যাৎ! বহুবার চেষ্টা করেও সফল না হয়ে শেষ পর্যন্ত ফুলি ছোটে বাড়ির পানে।তার মাথায় রুক্ষ চুলের সারিরা দুলে দুলে উঠছে বাতাসে।ধানক্ষেতে যেন বাতাসের তোড়ে ঢেউ উঠেছে।ফুলির গায়ের ময়লা জামাটার রঙ আগে সাদা ছিলো।এখন তা ধূসর ছাইবর্ণ।মানুষের সাথে সাথে পোশাকেরও তো বিবর্তন ঘটতে হবে।তাই না।এই তপ্ত রোদে পা রাখা মুশকিল। অথচ পাঁচ বছরের ফুলি খালি পায়ে দৌড়ে যাচ্ছে বাড়িতে।বাতাসে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে একটা ভো ভো শব্দ হচ্ছে।তার মাঝ দিয়ে বহুদূর থেকে দেখা যাচ্ছে শীর্ণ দেহের একটা মেয়ে দৌড়ে যাচ্ছে।হাতে তার দু গুচ্ছ কাশফুল।
মা উঠানের কোণে চুলায় রান্না বসিয়েছে।তার দৃষ্টি আকাশ পানে।আকাশে মেঘ করেছে।এখন বৃষ্টি নামলে রান্না করার উপায় নেই।চুলার উপর যে পাটখড়ির চাল ছিলো পরশু ঝরে তা উড়ে গেছে।ফুলিদের ঘর বহুকষ্টে টিকে আছে।ঘরের বারান্দার ভাঙা চৌকিতে বসে বসে মুখ দিয়ে একধরনের আওয়াজ করছে ফুলির বড় দিদি উমা।উমা প্রতিবন্ধী।তার পাশে শোয়ানো ফুলির ছোট ভাই খোকন।অনেকক্ষণ ধরে চিৎকার করছে। বোধহয় ক্ষিদে পেয়েছে। খাটের কোণে বসে পান পিষছে ফুলির শতবর্ষী ঠাকুরমা।বয়সের তোড়ে তার হাত বারেবারে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এর মধ্যে হঠাৎ ফুলি দৌড়ে এসে উপস্থিত।
-এই যে উড়নচণ্ডী আইছেন?তা নাওয়া খাওয়া কী হইবোনা?বেলা তো ডুইব্বা গেলো।
-আমার তো খুধা লাগছে মা।ভাত খাইতে দিবানা?
-ভাত!
তোর বাবা অহনই আইসা পড়বো মা।তুই নাইতে যা।তোর বাবা চাউল আনলেই আমি ভাত চড়াইয়া দিমু।
-সত্যি কইতাসো তো?
-হ মা।সত্যি।
-মা?(ফুলি দৌড়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে)
-কী?
-পরশু তো পূজা মা।আমারে কী এইবারেও জামা কিন্না দিবা না মা?
ফুলির মা ফুলির দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে।
-মা গো আমি বাজারে যাইয়া দেইখ্যা আইসি।রতনের দোকানে কী সুন্দর একটা লাল রঙের জামা আনছে!কী সুন্দর জানো মা?আমারে না পড়লে এক্কেবারে পরিগো মতো লাগবো।
কও না মা, দিবা কিন্যা আমারে ওই জামাডা?
কও না মা।(ফুলি তার মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে।)
ফুলির মা কিছুক্ষণ মাটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চুলার রান্না নাড়ায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
-কও না মা দিবা?
-যা বাবা নাইতে যা।দেহি তোর বাপে কী কয়।
ফুলি খুশিতে চেচাতে চেচাতে ছুটে যায়।তার ভাব দেখে মনে হয় তার সেই লাল রঙের জামা তার হাতে এসে পড়েছে।
সন্ধ্যাবেলায় সুবল মাঠের কাজ শেষে বাড়ি ফেরে।ফুলির মা তাকে খাবার বেড়ে দেয়।তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে।থালায় প্রাপ্তবয়স্কের জন্য অপর্যাপ্ত অন্ন আর কুমড়ো ফুলের বড়া।তা দিয়েই তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে সুবল।একটু পর পর প্রবল বেগে কেশে উঠছে সে।একটু পরই তার তোয়াক্কা করে ফুলির মায়ের সাথে কথা বলে যাচ্ছে।গরীবের কাশির দাম নেই।
-বুঝছো ফুলির মা,আর কয়টা টাকা জোগাড় করতে পারলেই শিবুদের ধার শোধ করতে পারুম। আর ওরা খোটা দিতে পারবে না।
কিগো গিন্নি,তোমার হইছেটা কী।কিছুই কইতাছো না যে,শরীরটা খারাপ না কী?
জ্বরটর বাধাইসো নাকি আবার?
-ব্যাঙের আবার শর্দি!কইতাছিলাম কী,মাইয়াডা বড্ড বায়না ধরছে।রতনদের দোকানে একটা লাল জামা দেইখা আইছে।একটা বার পূজায়ওতো ওদের গায়ে একটু সুতা জড়াইতে পারি না।এবারও কী তবে হইবোনা?
-বাজারের অবস্থা ভালো না গিন্নি।সবকিছুর চড়া দাম।আমাদের মতো মানুষের এবার না খাইয়া মরার সময় আইসা গেছে।
-রায়বাবু মজুরি দেয় নাই?
রায়বাবুর মাঠে বোধহয় কাজ কইরা লাভ হইলো না।মজুরি চাইতে পারতাছি না।বড়লোক মানুষ, একচুল এইদিক ওইদিক হইলে ভিটাছাড়া হইতে হইবো।
সুবল নিশ্বব্দে খেয়ে ওঠে।ফুলির মা ও কথা বাড়ায় না।ছোট্ট কুটিরের উপরে নিঃশব্দে একটা রাত অতিবাহিত হয়ে যায়।
আজ ষষ্ঠী। পূজোর মন্ডপে ঢাক বাজছে।শিশু, বধূ সবাই উৎসবে মেতেছে।উৎসবে মাতেনি শুধু সেই ছোট্ট কুটির।ফুলির সেই লাল জামা আসেনি।রোজ সেই জামাটা সে দোকানে গিয়ে দেখে আসতো।কিন্তু বাবা কিনে দিতে পারেনি সেটা।ফুলির গায়ে এখন ভীষণ জ্বর। মা তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে।বাবা উদ্দিগ্ন হয়ে বসে আছে।
-মাইয়াডার জ্বর তো বারতেই আছে।
-কী যে করুম!
-পূজা শুরু হইয়া গেছে।অথচ আমার ঘরে যে তার আনন্দ নাই।মাইয়াডায় রোজ রতনের দোকানে যাইয়া লাল রঙের জামাডা দেইখা আসতো।আইজ যায় নাই।
-আমারও কী ইচ্ছা করে না ফুলির মা,ফুলিরে একটা জামা কিন্না দেই!নতুন জামা পইড়া আমার ফুলিও অন্য পোলাপানের লগে পূজা দেখবো।
আমি সকালে গেছিলাম রায়বাবুর কাছে।উনি তো আমারে কুকুরের মতো তাড়াইয়া দিলো।
হঠাৎ ফুলি জ্বরের ঘোরে কথা বলে ওঠে।তার কণ্ঠে আড়ষ্টতা
-আমার লাল জামাডা যে বিক্রি হইয়া যাইবো।আমি জামা দেখতে যাই নাই আজকে।আমারে জামাডা কিন্না দাও বাবা।
-নাহ।আমার কিছু একটা করতেই হইবো।
-কী করবা তুমি?
-দেহি কী করি।
পরদিন জ্বর ভালো হয়ে ওঠে ফুলির।
জীবনে কোনদিন যে মানুষটা অসৎ পথে চলেনি সে আজ সেই অসৎ পথেই এগোচ্ছে।এই সময়ে বাজারে প্রচণ্ড ভীড় থাকে।দোকানদারেরা খদ্দের সামলাতে ব্যাস্ত।ফুলির সেই লাল রঙের জামাটা দোকানের এক কোণে ঝুলানো।ওখানে মানুষ বলতে গেলে নেই।সুবল এগোচ্ছে একটু একটু করে।কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছনে চলে আসে।তারপর হঠাৎ আবার এগোয়।তার চোখেমুখে বিষন্নতা, অপরাধগ্রস্থতা,ভয়,বিষাদ।মানুষের পরিস্থিতিতে পড়ে কতকিছুই করতে হয়।আজ যদি সে জামা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে তবে লোকে কী বলবে!অবশ্য গরীবের আবার আত্মসম্মান! যেখানে দুবেলা দু মুঠো খাওয়া অনিশ্চিত সেখানে আবার আত্মসম্মান!সুবল মনে মনে বলে
-মাগো,তুমি আমারে ক্ষমা কইরা দিও।তোমার পূজার দিন আমি কি না চুরি করতাছি!
খুব সন্তর্পণে সে জামাটার কাছে যায়।তারপর জামাটা হাত দিয়ে নামিয়ে পিছন দিকে সরে পড়ে।কিন্তু তার অপক্ক কাজ বেশিদূর যায় না।হঠাৎ করেই দোকানের কর্মচারী চোর চোর বলে চিৎকার করে ওঠে। তারপর যা হওয়ার তাই হয়।একটা বিষাক্ত সাপ পেলে মানুষ যেভাবে তার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে সুবলের ওপরেও সব মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে।সুবল ডুকরে কেঁদে ওঠে।কিন্তু দরিদ্রদের সেই অর্থবহ কান্না কারো কর্ণকুহরে সাময়িক এর জন্যও পৌঁছায় না।মানুষ তখন যেন উৎসবে মেতেছে।মানুষ মারার উৎসব।মানুষ বললে ভুল হবে।সমাজের চোখে দরিদ্র আর কীট সম।সবার চড়াও বাহু সুবলকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে।তার আর্তচিৎকার শোনার কেউ নেই।মানুষের উৎসব যখন শেষ হয়ে যায় তখন সুবলের রক্তাক্ত দেহ নিস্প্রান।
হঠাৎ মানুষের ভীড় ঠেলে ফুলি ভিতরে ঢুকে চিৎকার করে,
-আমার বাবারে মাইরো না তোমরা। ছাইড়া দেও।ছাইড়া দেও আমার বাবারে।
বহু কষ্টে ফুলির সেই ক্ষীণ আওয়াজ বোধহয় তাদের কানে পৌঁছায়।ফুলির কান্না হয়তো একটুর জন্য হলেও তাদেরকে অমানুষ থেকে মানুষে রুপান্তরিত করে।সবাই সরে যায়।অবাক হয়ে সেই মানুষগুলো ফুলির কান্না দেখে।সুবলের রক্তে ফুলির জামাটা লাল হয়ে গেছে।ঠিক তার সেই পছন্দের জামাটির মতো।
ফুলির চিৎকারে তখন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।তার চিৎকার যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে।প্রকৃতি হয়তো এই কষ্ট বুঝতে পারে।আকাশ গর্জে বৃষ্টি নামে।মুশলধারার বৃষ্টি।
একে একে প্রায় সব মানুষগুলো দূরে সরে পড়ে।কিছু কিছু মানুষ কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় এর মতো।অন্যবারের মতো এবারও তাদের শারদ খুশির হয়নি।ফুলির চিৎকারে সেদিন সুবল ফিরে আসেনি।মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসেনা।
Nice
ধন্যবাদ 💙
👍👍
ধন্যবাদ 💙
Good Post..
ধন্যবাদ 💙
সত্যিই অসাধারণ একটা গল্প। মন ছুয়ে গেল
Valo Laglo
nice post
bah…
ধন্যবাদ 💙
khub sundor
ধন্যবাদ
nice post
well
nice post
❤️