সমুদ্রের সন্তানেরা (চতুর্থ পর্ব)

আধ ঘন্টা পর…। আমরা সবাই লাইফবোটে উঠে পড়েছি।নৌকোগুলোকে জাহাজের অনুপাতে বড়োই বলা চলে।সবমিলিয়ে দুটো লাইফবোট পাশাপাশি ভাসছে এখন।একটাতে আমি,ক্যাপ্টেন এবং বিজ্ঞানীরা, অন্যটায় খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি রাখা রয়েছে।মাঝিমাল্লাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেসব দেখাশোনা করার। অন্য যন্ত্রপাতির সাথে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা বাক্সটাকেও  ওই বোটে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমি কিন্তু ম্যাক রাজি হলেন না।বাক্সটার প্রতি আমার কৌতুহল সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে এখন। যে করেই হোক,জানতেই হবে কি আছে ওই বাক্সটাতে?প্রয়োজনে ক্যাপ্টেনকে বলে…।

ক্যাপ্টেনের কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার।বেচারাকে এখন একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে তাঁর।কেবিনে আমাকে যে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি এখনও  সেগুলোই বলে চলেছেন একনাগাড়ে।তবে তার কথাগুলোকে পাগলের প্রলাপ বলতে এখন আর রাজি নয় আমি।যে দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখেছি সেটাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ বা যুক্তি নেই আমার কাছে।

জাহাজটা আমার চোখের সামনেই ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে।জানি না কেন বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো।আমিসহ লাইফবোটের  বাকি সবাই হা করে তাকিয়ে আছে ডুবন্ত জাহাজটার দিকে।উঁহু, ভুল বললাম।জাহাজের দিকে নয়, ওঁরা সবাই তাকিয়ে আছে জলযানটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখা শুঁড়ের মালিকের দিকে।কি বিভৎস দেখতে ওই জীবটাকে!সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি।তখনই চোখাচোখি হয়ে গেল জাহাজে পরিচিত হওয়া দ্য গ্রেট প্রফেসর ইখওয়ানুল ইসলামের সাথে।থতমত খেয়ে গেলেন তিনি।তাড়াহুড়ো করে সরে গেলেন বোটের অন্যদিকে।একটু আগে নিজের বলা কথাগুলো এখনো হয়তো পীড়া দিয়ে চলেছে তাঁকে।

বাতাসে নোনা পানির সোঁদা গন্ধ।সেইসাথে ক্যাপ্টেনের কর্কশ চিৎকার অণুরনিত হচ্ছে তাতে,“আমাকে যেত দাও তোমরা।কেন…কেন আটকে রেখেছ এভাবে?তাকিয়ে দেখ, এখনো নিজের আবাসস্থলে ফিরে যান নি তিনি।আ…আমাকে যে…তে দাও ওঁনার কাছে।তাকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে দাও…আমাকে।কি বললে?মারা যাবো?মহামূর্খের দল,তাকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্যের কাছে মৃত্যুও ম্লান হয়ে যায়।জানো না…তোমরা জানো না সেটা।প্লিজ,আর দেরি করো না খুলে দাও আমার হাতের বাধন,খুলে দাও।“

পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ডেকে আনা হলো ম্যাথুয়েল ম্যাককে।তিনি এসে দেখলেন হাত বাধা অবস্থাতেও একটা খুঁটির সাথে নিজের মাথা ঠুকছেন ক্যাপ্টেন।মাথা ফেটে রক্ত চুইয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।

“ওঁর হাতের বাঁধন খুলে দাও।যেখানে যেতে চাই যাক,পাগলটা।“ শান্ত কন্ঠে বললেন ম্যাক।সঙ্গে সঙ্গে পালিত হলো তার নির্দেশ।বাঁধন খুলে দেওয়ার পর আমার থেকে শেষ বিদায় নিতে এলেন ক্যাপ্টেন।আমার হাতদুটো চেপে ধরে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে।তারপর অতি দ্রুততার সাথে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।বৃদ্ধ হাতে সাগরের নোনাজল কেটে এগিয়ে গেলেন ওই মূর্তিমান বিভীষিকার দিকে। চোখজোড়া আপনা হতেই ঝাপসা হয়ে এলো আমার।

ক্রমশ…

Related Posts

12 Comments

মন্তব্য করুন