সমুদ্রের সন্তানেরা (তৃতীয় পর্ব)

-“আচ্ছা ইখওয়ানুল, তোমাদের এই প্রজেক্টটা ঠিক কিসের? না, মানে খুব গোপনীয় ‍কিছু হলে বলার দরকার নেই।এমনি, একটু কৌতুহল হচ্ছিল বলে…” -“আরে ভাই, তোমাকে বলব কিভাবে?এই প্রজেক্ট সম্পর্কেতো আমাদেরই কিছু জানানো হয়নি বিজ্ঞান কাউন্সিলের তরফ থেকে।শুধু ম্যাক হয়তো কিছু কিছু জানেন তবে বিস্তারিত নয়-এতটাই গোপন এই প্রজেক্টটা।সত্যি বলতে কি আমারও বেশ কৌতুহল হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিয়ে!“

-“আচ্ছা, এই মিশনে তো তোমরা চারজন এসেছো। বাকি তিনজন কোথায়?”প্রশ্নটা করেই বুঝলাম-বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে ফেলেছি।আসলে ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানীদের প্রতি আমার কৌতুহল বাড়াবাড়ি রকমের বেশী।কেন জানি না শৈশবে বিজ্ঞানীদের অন্যগ্রহের মানুষ মনে করতাম আমি।স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার শৈশবের সুপার-হিরোও ছিলেন এই বিজ্ঞানীরাই-যারা কিনা মৃত্যরে হাজার বছর পরেও নিজের আবিষ্কারের মাধ্যমে উপকার করে চলেছেন সমগ্র মানব সভ্যতার!

-“বুড়োটা মানে এই মিশনের হেড ম্যাথুয়েল ম্যাক নিজের কেবিনে শুয়ে আছে।মনেহয় সমুদ্রপীড়ায় আক্রান্ত হয়েছে,হতচ্ছাড়া।দ্বিতীয়জন নিজের কেবিনের দরজা ভেতর থেকে লক করে রেখেছে কাজেই সে ঠিক কি মহানকার্য করছে সেটা বলতে পারব না।“ইখয়ানুলের কথায় ধ্যান ভঙ্গ হলো আমার।

-“হুম,বুঝলাম।আরেকজন?”আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ডেকের রেলিং ঘেষে অঙ্গুলি নির্দেশ করল ইখওয়ানুল।সেদিকে তাকাতেই‌‌ দেখতে পেলাম একটা ছেলে চেয়ার পেতে বই পড়ছে।তাঁর মুখ হাসি হাসি।চেহারা দেখে মনে হলো বয়সে আমার চেয়ে দু-এক বছরের ছোটই ‌হবে সে।‌‌‌‌

-“ওঁর মুখটা কেমন হাসি হাসি দেখেছ?অথচ হাবাটা কিন্তু  ম্যাথমেটিক্সের একটা বই পড়ছে। কোন মানে হয়?আরে বাঁদর,অঙ্কের ভেতর আবার হাসার কি আছে?তুইতো আর কোন জোকসের বই পড়ছিস না যে…।”মাঝপথে কথা থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো ইখওয়ানুল,

-“আচ্ছা, লোকজন যেই শুঁড়ের কথা বলাবলি করছিল সেটা কি তুমি নিজের চোখে দেখেছ?”প্রশ্নটা তিনি এমন ভঙ্গিতে করলেন যেন এইমাত্র মনে পড়েছে কথাটা।

-“না,নিজের চোখে দেখিনি আমি।তবে আমার খুব পরিচিত একজন দেখেছে।দেখতে নাকি অনেকটা ওই অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো সেটা।“

‍‍-“যত্তসব বোগাস কথাবার্তা…।“

-“আ…হা…হতেও তো পারে এই মহাসমুদ্রের অতলে এতদিন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে  ছিল কোন প্রাগৌতিহাসিক,নাম না জানা, জীববিশেষ।এখন সেটাই…“

-“উঁহু…প্রাগৌতিহাসিক জীবটিব কিছু নয়,সব হলো এই অশিক্ষিত নেটিভদের তৈরি করা মিথ,বুঝলে?সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে আট-নয়বার চোবালেই শুঁড় দেখার ভূত নেমে যাবে শালাদের মাথা থেকে।আর যদি ভুল করেও কোন ক্রিয়েচার থেকে থাকে এই সাগরে তাহলে আমার সামনে আসতে বলো, ওঁর সুবিশাল শুঁড় দিয়ে আমি কান চুল…“

কথাটা শেষ করতে পারলেন না প্রফেসর।তার আগেই ভীষণভাবে পুনরায় কেঁপে উঠল জাহাজটা।কাঁপুনির মাত্রাটা এতই বেশী যে আমি আর প্রফেসর দুজনেই প্রায় ছিটকে পড়ে গেলাম ডেকের ফ্লোরে।এতক্ষণ গল্পে মগ্ন থাকা মানুষদের ভেতর মূহুর্তেই একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো।সবাই প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল নিরাপদ কোন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।একটু আগে যে তরুণ বিজ্ঞানীটা বই পড়ছিল—তাকে দেখলাম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে।জামা-কাপড়ে ধূসর ধূলো লেপ্টে রয়েছে তাঁর।ঝাঁকুনি খেয়ে আমাদের মতোই ফ্লোরে পড়ে গিয়েছিল মনে হয়। তাঁর হাতের বইটাকে আর কোথাও দেখতে পেলাম না।এমন দুঃসময়েও কেন জানি না হাসি পেল আমার।খানিক বাদে সংবিৎ ফিরতেই ছুট লাগালাম জাহাজের অপর প্রান্তে। লাইফবোটগুলো এতক্ষণে প্রস্তুত করে ফেলার কথা।

ক্রমশ…

Related Posts

9 Comments

মন্তব্য করুন