সুন্দরবনে বনজীবি ভক্ত মনে হাজার বছর জায়গা করে আছে বনদেবী

ম.ম.রবি ডাকুয়াঃ

বিশ্বের দ্বিতীয় অশ্বর্য ও বহু গভীরতর ঘটনা অঘটন আর দূর্ঘনার আঁধার সুন্দরবনে নানান কথিত লোকজ ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।যা কিনা হাজার বছরের ইতিহাসে আর লোক কাহিনীর লোক গাঁথা হয়ে আছে।

বনদেবী বা বনমা ব্যাঘ্রদেবী  হিন্দু ধর্মের দেবী ও কিছু কিছু বনবাসী মুসলমানদের পীর মা ।সুন্দরবনের বাংলাদেশ ও ভারতীয় কিছু অংশে ও এর আশেপাশের অনেকের মধ্যে মানত করার প্রবনতা দেখা যায় যেমন মুরগী ছাগল বা গরুও এরা বন দেবী বা বনমার নামে ছেড়ে আসে।স্থানীয় বনজীবিদের জনগোষ্ঠী বাঘের আক্রমণ হতে রক্ষা পাবার জন্যে বনবিবির পূজো করেন। কেউ কেউ আবার দয়াল পীর গাজি কালুর নামে শিন্নি মানত করেন।এ কথাও প্রচলিত আছে যে, নিষ্ঠুর রাজা দক্ষিণরায় (রায়মণি) হিংস্র বাঘের ছদ্মবেশে মানুষের উপর হামলা করেন।

 

সুন্দরবনে ঘুরতে গেলে হঠাৎ চোখে পড়বে আচমকা হঠাৎ কোন মন্দিরের।কোনও কোনও ভক্তরা মন্দির তৈরী করে ব্যাঘ্র-দেবদেবী বনবিবি, দক্ষিণরায় ও কালুর একসঙ্গে পূজা আর্চনা করেন।

সুন্দরবন অঞ্চলের লোকায়ত দেবী যিনি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে উভয়ের দ্বারা পূজিত হন। মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, মৎসজীবীদের দেবী বনবিবি, বাঘের তথা দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবেন এই বিশ্বাস তারা আজও লালন করে।ইতিহাসবিদদের মতে খুলনার বিভাগের ইতিহাস বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০ সালের সময়ে সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই-মোনাই এবং আলোচনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বনবিবি ইব্রাহিম (মতান্তরে বেরাহিম) নামে এক আরবদেশি ব্যক্তির  কন্যা। ইব্রাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতিনের প্রতিহিংসার প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হন। সেখানে বনবিবির জন্ম লাভ হয়। দক্ষিণ রায় যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীন ভাটির দেশের রাজা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। দক্ষিণ রায়ের পরাজয় অর্থে বাঘ বা অপশক্তির পরাজয়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনের বহু অঞ্চলে লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেন দেবী বনবিবি। দেবীর পীরমাহাত্ম্যবিষয়ক কাব্যের নাম বনবিবির জহুরানামা। এই আখ্যান মঙ্গলকাব্যের ঢঙে রচিত হলেও আল্লাহ-রসুল, মক্কা, পীর-পীরানি যুক্ত আছে। অরণ্যচারী মানুষের বিশ্বাস, ভক্তি ও জীবনধারা এতে বর্ণিত হয়েছে। কিছু গবেষক দের মতে তিনি হিন্দু দেবী বনদুর্গা‌,বন চণ্ডী,বন ষষ্ঠ‌ী বা বিশালাক্ষী।বাংলাতে ইসলামিক প্রভাবে বনবিবি হয়েছেন।

বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে বনবিবিকে নিয়ে কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে:

এক সওদাগরের দুই স্ত্রীর কাহিনী রটিত আছে। ছোটো বউয়ের কূচক্রান্তে সন্তানসম্ভবা বড়ো বউ গুলালবিবি সুন্দরবনে নির্বাসিতা হন। কয়েকদিন পর সেখানেই যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিতে সক্ষম হন অতপর মৃত্যু বরন করেন। জন্মজাত শিশু দ্বয়ের  কান্না শুনে বনের বাঘ, কুমির, হরিণ, অজগর, বানর সবাই ছুটে আসে। তারাই দুই ভাইবোনকে লালনপালন করে বড়ো করে তোলে। কৌশর পেরিয়ে ছেলেটি বড়ো হয়ে বাঘের রাজা এবং মেয়েটি বনবিবি নামে পরিচিত হয়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই বনবিবি হলেন মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। তাঁরা মনে করেন, বনের বাওয়ালি-মৌলেরা বাঘের মুখে পড়লে বনবিবির নাম স্মরণ করে মন্ত্র পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘও দৌড়ে পালিয়ে যায়। অদ্যাবধি স্থানীয় মানুষ বনে কাজে যাওয়ার আগে বনবিবির পূজা করে।গুলালবিবি শাহ জংগলীর হাতে বনবিবিকে রেখে চলে যান। বনবিবি জঙ্গলে প্রকৃতির সন্তান হিসেবে লালিত পালিত ও বড় হয়। সাত বছর পর, ইব্রাহিম তার ভুল বুঝলেন এবং গুলালবিবি ও তার দুই সন্তানকে মক্কাতে নিয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনা যায়।একবার, ইসলামের নবীর মসজিদে প্রার্থনা করার সময়, বনবিবি এবং শাহ জঙ্গলীর দুটি যাদুর টুপি পেয়েছিল বলে জানা যায়। ঐ ঐন্দ্রজালিক টুপিগুলির সাহায্যে তারা ভারতের আঠারোটি জোয়ারের দেশে চলে যায় । সেখানে পৌঁছার পর, শাহ জঙ্গলী প্রার্থনা করার আহ্বান করেন। আঠারো জোয়ারের(সুন্দরবনের) দেশ তাদের আগমনের পূর্ব থেকে দানব রাজা দক্ষিণ রায়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রার্থনার শব্দ তার কানে যখন পৌঁছালো। তিনি তার বন্ধু সনাতন রায়কে তাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য পাঠালেন। যখন সনাতন তাদের দুজনের ব্যাপারে অবহিত হলেন তখন তিনি তাদের এলাকা থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন।

বারিজহতি নামে এক গ্রামে দুইজন ‘মৌয়াল(মধু সংগ্রাহক)  ধনাই ও মানাই ছিল।এরা সম্পর্কে দু ভাই আঠারো জোয়ারের দেশের একটি জঙ্গল’মহলে’ (ঘন জঙ্গলে) মধু সংগ্রহের জন্য ধনাই সাতটি নৌকা নিয়ে একটি অভিযানের জন্য যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার ভাই মানাই তার বিরোধিতা করে বসেন।তিনি একটি গরীব মেষপালক ছেলে, দুখেকে তার সাথে নেন।নৌকা ছাড়ার আগে, দুখের মা তাকে কোন গুরুতর সমস্যায় বনদেবীকে স্মরণ করার আদেশ করেন।যখন তারা কেন্দুখালি চর পৌঁছেছিল ( যা তখন ডাকাত রায়ের রাজত্বের অংশ ছিল) , তখন দক্ষিণ রায়কে উপহার দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। যার কারনে সে তিন দিবসের জন্য কোন মধু সংগ্রহ করতে সক্ষম হন নি। তৃতীয় রাতে, দখিন রায় তার স্বপ্নে হাজির হল এবং মানুষের বলিদানের জন্য বলল।দক্ষিণ রায়ের সাথে কিছু বিতর্কের পর, লোভী ধনাই মধু ও মোমের বিনিময়ে দুখেকে উৎসর্গ করার জন্য রাজি হন। তাই, যথেষ্ট পরিমাণে মোম এবং মধু সংগ্রহের পর তিনি দুখেকে ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। বাঘের ছদ্মবেশে দক্ষিণ রায় যখন দুখেকে হত্যা করতে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বনদেবীকে স্মরণ করেন। তাঁর প্রার্থনা শুনে বনদেবী তার ভাই জঙ্গলীর সাথে এসেছিলেন।দক্ষিণ রায়কে পরাজিত করে জংগলী। পরাজয়ের পর,দক্ষিণ রায় , খান গাজী (গাজী পীর) -এর আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা সেখানে দক্ষিণ রায়ের পিছু পিছু যান। অবশেষে, গাজী দক্ষিণ রায়ের ক্ষতি সাধন না করার জন্য বনদেবীকে রাজি করান। পরিবর্তে, গাজী দুখেকে মূল্যবান সাতটি কার্টুলি দিয়েছিলেন, আর রায় তাকে যথেষ্ট মোম এবং মধু দিয়েছিলেন। এ ও কথিত আছে পীর গাজী তার এক ধরনের বিশেষ শক্তি সম্পন্ন (আশা)নামে পরিচিত বর সম্বলিত এক পিতল বা কাঁশা ধতব দিয়ে গেছে তার একান্ত ভক্তকে যা দ্বারা তারা অলৈকিক প্রতিভা সাধন করতে পারেন ।বনবিবি তার পোষা মুরগিদের আদেশ দেন, দুখেকে তার গ্রামে রেখে আসার জন্য। গ্রামে ফিরে আসার পর, দুখে আশেপাশে বনদেবীর উপাসনাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। পরবর্তীকালে,তিনি ধনাইয়ের মেয়ে চম্পাকে বিয়ে করেন এবং তিনি গ্রম প্রধান হন।

 

এভাবে শত শত বছর নানান ভাবে স্থানীয় হিন্দু মুসলিম বনদেবী কে স্মরণ ও পূজা আর্চনা করেন।তারা তাকে মানত করেন বিধায় তারা বিপদ আপদ থেকে মুক্ত থাকেন এবং আশির্বাদ পুষ্ট হতে এ ধরনের ভক্তি আজও প্রচলিত আছে।তাই তারা বনে জীবিকার সন্ধানে প্রবেশের আগে সেখানে বা তার উদ্দেশ্যে নানা রকম পূজা আর্চনা করে থাকেন।

 

 

 

Related Posts

16 Comments

মন্তব্য করুন