মোটরসাইকেল ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুব কমই আছে। বিশেষ করে যারা তরুণ তাদের কাছে ফ্যাশন এর আরেক নাম মোটরসাইকেল। একটি মোটর বাইক, একটি জীবনকে রঙিন করে তুলতে পারে। তরুণদের কাছে মোটরবাইক সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান সময়ে এর জনপ্রিয়তা তাই প্রমাণ করেছে। গল্পটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও ভিন্ন ধর্মী। গল্পটি ব্যক্তিজীবনকে স্পর্শ করে স্বপ্নময় ভুবনে সৃষ্টি করেছে এক আবেগময় কাহিনী। কাহিনী বেশ পুরোনো তবে খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। আজ থেকে প্রায় 10 বছর পূর্বে ফিরে যাচ্ছি।
তারুণ্য কে জয় করে নির্ভীক এক স্বপ্নময় তরুণ আমি। বয়স খুব বেশি না হলেও 18 বছর থেকে খুব দূরে নই। সবে মাত্র মেট্রিক লেভেল উদ্ধার করেছি। কোনরকম টেনেটুনে পাশ করতে পেরে ভালোই খুশি হয়েছিলাম। কলেজ জীবনে প্রবেশ করার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। এই বয়সে প্রতিটা জিনিস ঐ খুব আকর্ষণীয় হয়। প্রতিটি জিনিসের প্রতি দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার দোষ পুরোপুরি আমার নয়। কিছুটা দোষ বয়সেরও থাকে।
আমিও সেই বয়সে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে একটুও কৃপণতা করিনি। আমি যে বাবা-মার একমাত্র ছেলে ছিলাম তা নয়। আমার ছোট ভাই তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবা মা আর খুব আদরের দুটি সন্তান ছিলাম আমরা। বাবা খুব বড় ব্যবসায়ী কিংবা চাকরিজীবী না হলেও আমাদের অভাব কখনো তিনি বুঝতে দেননি। ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি আবদার পালনে বাবা-মার থেকে কখনো হতাশ হয়নি। হয়তো অবস্থা বিবেচনা না করে আমরা একটু বেশি আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম। ভালোই চলছিল দিনকাল। সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন কলেজে যেতাম। বন্ধু কিংবা বান্ধবী কোনটির কমতি ছিল না।
তবে মেয়েবন্ধুদের চাইতে আমার ছেলে বন্ধুদের সাথে বেশি ওঠাবসা হত। পাড়ায় সকলে মিলে আমার বাপ দাদার দেওয়ার নামটা তারা আমাকে না বলেই পাল্টে ফেলেছিল। সবাই তখন আমাকে বাবু বলে চিনত। অবশ্য নামটা এক সময় আমার টাইটেল নেম হয়ে গেল। তবে নাম নিয়ে খুব মাথাব্যথা ছিল না আমার। বরঞ্চ আমি খুশি হতাম, যখন আমাকে কেউ বাবু বলে ডাকত। অবসর সময়গুলো খেলাধুলা ও দোকানপাটে আড্ডা দিতে চলে যেত। আমাদের সবার প্রিয় দোকান ছিল, মজনু মামার দোকান। সবারই এরকম কোন না কোন প্রিয় জায়গা থাকে। আমারও ছিল।
মফস্বল এলাকা হওয়াতে আমরা নাইট ক্লাব কি তা কখনো চিনতামই না। সে সময় ফেসবুকে আর ইন্টারনেট কিংবা অনলাইনের এত জমজমাট অবস্থা কল্পনাই করা যায়না। তখন হাতের বাটন ফোন তাই ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল। কিন্তু আমাদের মনের বাসনা এবং কামনাগুলো তখনো ছিল এখনকার মতই ডিজিটাল। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এখনো মনে হলে মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কখনো ভালো গান গাইতে পারতাম না। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হতো তখন। তবুও বেসুরো গলায় আমরা বন্ধুরা মিলে মাঠে গান গাইতাম। তবে আমাদের সেই গান শোনার মত অডিয়েন্স কখনোই ছিল না। এমনিভাবে দিন অতিক্রম করতে লাগলাম। বেশ ভালোই চলছিল দিনকাল। মজনু মিয়ার দোকানে প্রতিদিন নিজের পরিবারের মতোই আড্ডা দিতাম।
সেও আমাদের কে আপন করে নিয়েছিল তার অর্থনৈতিক কাস্টমার হিসেবে। ছাত্র হিসেবে খুব ভালো না থাকলেও, বাবা পকেটমানি টা খুব ভালোই দিত। তখন বুঝতাম না বাবা মা কত কষ্ট করে আমাদের পড়াশোনা সেই খরচ খরচ চালাতে ন। যাইহোক বোঝার মত বয়স টা হয়তো তখন ছিল না। তারুণ্যের বয়সে হয়ত তেমনি হয়। একদিন বজলু মিয়ার দোকানে, আড্ডা দিচ্ছিলাম। ঠিক তখন আমার এক বন্ধু। খুব ক্লোজ বন্ধু, আমাদের সবাইকে দোকানে বসা দেখে, গাড়ি নিয়ে এসে ব্রেক করল। ওযে গাড়িটিতে এসেছিল সেটা ছিল একটি মোটর বাইক। ঘটনাটি তখন থেকেই শুরু। আমরা ওকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে, নতুন বাইক কিনেছিস নাকি? ও মুচকি হাসি দিলো। অবশ্য তখনকার দিনে একটি বাইকের মূল্য ছিল আকাশছোঁয়া। খুব ভালো পরিবারের না হলে পার্সোনাল বাইক কেনা টা ছিল খুব দুর্বিষহ।
তখনকার দিনে একটি বাইক থাকলে, রাস্তাঘাটের লোকজন চেয়ে চেয়ে দেখব। তাও আবার যদি গ্রাম কিংবা মফস্বল শহরে হয় তাহলে তো কথাই নেই। যাই হোক, সেদিন আশরাফুল গাড়ি থেকে নেমে ছিল।তবে তার হাসির কারণটি কিছুক্ষণ পরে আমরা বুঝতে পারলাম। যখন শুনলাম যে বাইকটি পড়ে এসে এসেছিল সেটি তার নিজের নয়। আমরা প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, তারপর বিষয়টি আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম। আসলে ও বাইকটি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল। বাইক ভাড়া পাওয়া যায় একথা শুনে আমরা মনে মনে একটু খুশি হলাম। যাইহোক কিনতে তো পারব না, ভাড়াতে হলেও কখনো কখনো শখ মিটিয়ে নেওয়া যাবে। সেদিন খুব খুশি হয়েছিলাম।
তখনকার সময়ে মফস্বল অঞ্চলে, বাইক ভাড়া পাওয়া যেত। প্রচলন টি তখনকার সময় থেকে শুরু হয়েছিল। আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন প্রায় প্রতিটি বন্ধুদেরই শখ ছিল মোটরবাইক চালানোর। অবশ্য কলেজে অনেকেই প্রাইভেট মোটর বাইক নিয়ে আসা যাওয়া করতেন। তবে তাদের সাথে মেশা টা আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। তারা ছিলো প্রত্যেকেই উচ্চ মধ্যবিত্ত। আমরা ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত। যদি মধ্যবিত্ত হতাম তাহলে হয়তো কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন যায় না খন্ডানো। দুনিয়ার এই বেহিসেবি নিয়মগুলো মাঝেমাঝে মনকে খুব কষ্ট দিত।
ইস আমরা যদি উচ্চবিত্ত কিংবা বিত্তশালী হতে পারতাম। টং দোকানে যখন চা খেতে যেতাম, তখন অনেকেই মোটরবাইক নিয়ে আসতো। আমি মাঝে মাঝে আড়চোখে সেই বাইকগুলোর দিকে তাকাতাম। মনের মাঝে খুব ইচ্ছা হতো ইস এমন একটি বাইক যদি আমার থাকতো। মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম। রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে অনেক রকম স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু সকাল বেলা যখন সেই স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যেত তখন খুব কষ্ট পেতাম। যে কষ্টগুলো শুধু আবেগের। স্বপ্নে অনেকবার বাইক চালিয়েছি। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতা এক জিনিস নয়। মাঝে মাঝে এলাকায় নতুন কোন বাইক দেখলে খুব ইচ্ছে হতো একবার চালিয়ে দেখবার। মনে মনে ভাবতাম, আমি হলে ঠিক এই কালারটা নিতাম।
আমি হলে এমন গাড়ি কিনতাম। আবার মাঝে মাঝে কিছুকিছু মোটরবাইক খুব পছন্দ হয়ে যেত। মনে হতো আমি যেরকমটা চয়েজ করে রেখেছি মনে মনে এই গাড়িটি ঠিক সেইরকম। এরকম হাজারো ভাবনা চিন্তা আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের নিত্যদিনের ব্যাপার। আমরা শুধু চিন্তা এবং স্বপ্নের মাঝেই সব কিছু পাই। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা কখনোই তা ছুঁয়ে দেখতে পারিনা। গল্পটি এরকম হতে পারত। কিন্তু আমার বেলায় সেরকম হয়নি। বাইকের প্রতি দুর্বলতা এক সময় আমাকে চাহিদার গোলাম বানিয়ে দেয়। মনে মনে প্রচন্ড জিৎ চেপে বসে।
যেভাবেই হোক আমাকে একটি বাইক কিনতে হবে। সেটা যেভাবেই হোক। আমি নানান রকম উপায় খুঁজে বের করতে লাগলাম।কিন্তু আমি যতই উপায় খুঁজে বের করি কোন কিছুতেই কোন কিছু সমাধান হয় না। এক সময় মনে হয় আমার এই স্বপ্ন কোনদিন পূরণ হবার নয়। দেখতে দেখতে ইন্টারমিডিয়েট লাইফটা শেষ করে ফেললাম। ভর্তি হলাম শহরের কোন এক কলেজে। অনার্সে আমি চান্স পেয়েছিলাম বাংলা সাবজেক্ট। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে সাংবাদিক হব। আমার বাবারও সেই স্বপ্নটা ছিল। বাড়ির বড় সন্তান হতে আমার ওপর সবার চাহিদাটা ছিল আকাশচুম্বী। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা সবচেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসতো। ছোট ভাইটিকে ভালোবাসো কিনা জানিনা তবে আমি বুঝতে পারতাম বাবা-মা আমার কাছে, ভবিষ্যতে কিছু চাইবে। সেই চাওয়াটা হতে পারে আমার ভালো একটি কেরিয়ার। বাবা লেখাপড়া করতে পারেননি।
তার স্বপ্ন তার ছেলেগুলো লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হবে। তবে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পরে মানুষ কিছু না কিছু বুঝতে শিখে। তখন সেই বয়স হয়ে যায়,। অ্যাডাল্ট পারসন হিসেবে তখন আমি মোটামুটি লেখাপড়ায় ব্যস্ত। বন্ধুবান্ধব আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে। তুমুল আড্ডা আর নতুন নতুন বন্ধুত্ব আমাকে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে তুলল। জীবনকে যতটা কালোজিরার মত ভেবেছিলাম জীবন ঠিক ততটা কাল নয়। দেখতে দেখতে দু বছর পেরিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে গেল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, বাবার অনেক বড় ধরনের একটি রোগ হয়েছে। বাবাকে কোনরকম চিকিৎসা করিয়ে কিছুদিন বাড়িতে থেকে গেলাম। ছোট ভাইটি ও এখন পড়াশোনা করছে।
বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে আমি একটু বেশি চিন্তা করতে লাগলাম। বাড়ির উপার্জনক্ষম ব্যক্তি টি ছিল শুধুমাত্র আমার বাবা। তার উপার্জনের উপরে পুরো পরিবারটি চলছিল। কিন্তু বাবা এখন অসুস্থ। মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এত বড় না তবে আমাদের চারজনের সংসার টি আস্তে আস্তে খুব ভালো অবস্থান থেকে নিম্ন অবস্থানে চলে যেতে লাগলো। আশেপাশের মুরুব্বী এবং আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে এখন আমাকে কিছু না কিছু করতে হবে। আমি ভাবলাম যতটুকু জ্ঞান আমার আছে, তা দিয়ে হয়তো কোনো রকম একটা চাকরি পেয়ে যাব।
আজকাল কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া সরকারি চাকরির মত হয়ে গেছে। তবুও এলাকার কোন এক বড় ভাইয়ের সুবাদে চাকরি নিলাম ঢাকা শহরে। মোটামুটি 2,4,5 মাস না যেতেই সবকিছু খুব সহজেই বুঝে গেলাম। আপ লেভেলের বসদের প্রচন্ড সহযোগিতায় আমাকে মোটামুটি টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। আমি কিছু কিছু টাকা তখন বাড়িতে পাঠাতাম। আর কিছু টাকা আমি ব্যাংকে জমাতাম। আর নিজে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতাম।এমনও দিন গেছে সকালের নাস্তা কি পর্যন্ত করতে পারে নি। মাঝে মাঝে একবেলা খেয়েছি। তবে সেসব ছিল শুধুমাত্র হিসেবের জন্য।
ব্যাংকে যে টাকা জমাতে শুরু করলাম, তা বছর দুয়েক পর খুব ভালো অবস্থানে চলে গেল। খুব কষ্ট করে দুটি বছর আমি টাকাগুলো জমিয়েছি। অবশ্য জমানোর একটি উদ্দেশ্য ছিল। অনেকেরই অনেক উদ্দেশ্য থাকে। তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমি আমার ছোটবেলার সেই স্বপ্নটা পূরণ করব। খুব ভালো মানের না হলেও, মোটামুটি একটি বাইক কিনবো। আর সেই বাইকে চড়ে, ঢাকা থেকে বাড়িতে যাব। মনে মনে বিষয়গুলো ভাবলে খুব খুশি হতাম।
পড়াশোনাটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কাজের চাপে পড়াশোনা হয় না। আর আমাদের মত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার করার মত পরিবেশ বেশিদিন থাকে না। পরিবারের লোকের বোঝা, আর বড় ভাই হিসেবে যে দায়িত্ব তা আমি কিছুটা হলেও পালন করতে পারছিলাম। একদিকে ভাবলে আমি খুশি ছিলাম। হঠাৎ করে একদিন অফিস থেকে ছুটি নিতে হলো। অফিস আমাকে খুব তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। কারণ আমি অফিসে সবার কাছে খুব প্রিয় ছিলাম। প্রিয় থাকার একটি কারণও আছে। অফিসের কমবেশি সবার সাথেই ছিল আমার ভদ্র আচরণ। আমরা মধ্যবিত্ত নই। আমরা নিম্নবিত্তের মানুষেরা মানুষ নিম্নবিত্তের হলেও ব্যবহারটা সব সময়ে ভালো রাখতে চেষ্টা করি।
কারণ একটাই কারণ আমরা নিম্নবিত্ত। বৃত্তের অহংকার না থাকলেও, অভদ্র হিসেবে সমাজে পরিচিত লাভ করতে চাই না। যাইহোক ছুটি পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। অনেকদিন পর বাড়িতে যাচ্ছি। ভাবতেই মনটা খুব আনন্দে নাচানাচি করতে থাকলো। আমি খুব দেরি না করে ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাবার অসুস্থতার টা কিছুতেই কম ছিলনা। ভেবেছিলাম বাবাকে, বড় কোন ডাক্তার দেখাবো। কিন্তু যে টাকা জমিয়েছি, সেই টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করতে গেলে আমার আর বাইক কেনা হবে না। তবুও বারবার মন চাইছিল বাবার চিকিৎসা টা আগে করি। বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে গেছিল।
বাড়িতে আসার পর বুঝতে পারলাম, আমি বাড়িতে কতটা ইম্পর্টেন্ট। মা, এমনিতেই আমাকে খুব বেশি ভালোবাসতো। আর এখন তো দূরে থাকি, এখন আগের চেয়ে আরো বেশি ভালোবাসাটা আমি উপলব্ধ করতে পারলাম। দুদিন পরের কথা, মাকে বললাম মা চলো বাবাকে ভালো কোনো ডাক্তার দেখাই। মা রাজি হয়ে গেলেন। বাবাকে নিয়ে শহরে এলাম। বড় কোন হসপিটালের বড় ডাক্তার দেখাবার সৌভাগ্য হয়ে গেল। অবশ্য ভিজি ট তুলনামূলক একটু বেশি ছিল। তবু আমরা নিম্নবিত্ত। ওসব নিয়ে মাতামাতি আমাদের মানায় না। ভালো একটি ডাক্তার দেখাতে পারছি সেটাই তো ভাগ্যের বিষয়।
অনেকক্ষণ পর বাবাকে ডাক্তার সাহেব দেখলেন। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও টেস্ট দিয়ে দেওয়া হল। আমি সারাদিন সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা টেস্ট গুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছিল আমার। তবুও আমি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বাবার চিকিৎসায় মনোযোগ দিতে লাগলাম। সন্ধ্যার পর রিপোর্টগুলো ডাক্তার সাহেবকে দেখালাম। ডাক্তার সাহেব সমস্ত রিপোর্টগুলো দেখার পর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি ডাক্তার সাহেবের মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম বাবার অবস্থা খুব ভালো নয়। কারণ আমাদের ভালো রেজাল্ট টা খুব কমই আসে।
আমাদের ভাগ্যটাই বোধ হয় এরকম। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সাহেব আমাকে আস্তে আস্তে বললেন। বাবাকে ভালো চিকিৎসা করাতে হবে। প্রয়োজন হলে অপারেশন করতে হতে পারে। তা না হলে বাবাকে আর বাঁচানো যাবেনা। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ডাক্তারসাব কত খরচ হতে পারে। ডাক্তার সাহেব মুখ বাঁকিয়ে আমাকে বলল খুব বেশি না তবে লাক টাকা খরচ হবে। তুমি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।তিনি যেটা বুঝালেন সেটা হচ্ছে তাদের হাসপাতালে করলে একটু কম খরচ হবে। তবে ওষুধপত্র এবং অপারেশন খরচ বাবদ, খরচের অ্যামাউন্টটা গিয়ে পৌঁছবে 2 লক্ষ টাকার কাছাকাছি। আমি অনেক ভেবে দেখলাম। মা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। মা হয়তো আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল।কিন্তু মার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম মাকি বলতে চাইছিল। আমি মার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর আমি চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করলাম, বাবার চিকিতসা তাই আমি করব। আমার ব্যাংকে যে টাকা আছে, সে টাকা হলেই বাবার চিকিৎসা টা হয়ে যাবে। মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমার এত কষ্টের টাকাগুলো দিয়ে আর বাইক কেনা হবে না। হয়তো কোনদিন আমি আর মোটর বাইক কিনতে পারব না। কারণ কিছুদিন পর আমার আর সেই রকম তারুণ্য থাকবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম। অবশেষে বাবার চিকিৎসা টা আমি সম্পন্ন করেছি। অপারেশন করার পর বাবা অনেকদিন সুস্থ ছিলেন। তবে ভাগ্যের পরিহাসে লিখে রাখা আমাদের এই নিম্নবিত্ত জীবনে সুখ বেশিদিন টিকে না।
ঠিক এক বছর পর বাবা মারা গেলেন। অপারেশন করেও বাবাকে বেশি দিন বাঁচে রাখা গেল না। এখন আমি ভাবছি,, আমার স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে যাবে নাকি কখনো সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে পারবো। এখনো আমি স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নে মাঝেমাঝে এখনো আমি মোটর বাইক চালাই। বাস্তব জীবনে চালাতে না পারলেও কল্পনার জগতে আমি নিম্নবিত্ত নই। আমার একটি মোটরসাইকেল ও লাল নিল নিল জীবনের গল্প এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তা আমি কখনো ভাবতেই পারিনি। আমার বয়স এখন অনেক বেশি। এখন আর স্বপ্ন স্বপ্ন দেখিনা। তবে মাঝে মাঝে, অন্য কাউকে বাইক চালাতে দেখলে, আমার অতীতের কথা খুব মনে পড়ে। তখন আমি ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পাই। সেদিন রাত্রে আমি হবার স্বপ্ন দেখছি, আমি খুব সুন্দর একটি মোটর সাইকেল চালাচ্ছি। আমার সেই মোটর সাইকেলের পিছনে আমার বাবা বসা রয়েছেন।
Writing by Momin Sagar