আরও বছর পাঁচেক আগে যখন আমি ভার্সিটিতে পড়তাম তখন আমাদের ভ্রমন পিয়াষু একটা গ্রুপ ছিলো। হুটহাট করেই নতুন নতুন স্থান ভ্রমনের পাগলা ঘন্টাটা বেজে উঠতো কারও না কারও মাথায়। এর আগেও এমন ভূত চেপেছিলো। গিয়েছিও বটে। এবার এক বন্ধু বললো চল বান্দরবানে যাই। যেই কথা সেই কাজ। অন্যরা সবাই বলে উঠলো, তো অনেকদিনতো কোথাও ঘুরতে যাই না। চল সবাই মিলে ঘুরতে যাই। এ রকম করেই এর আগে আরও পাঁচটা ট্যুর হয়েছে। এবারও তাই হবে, হলোও।
প্রথমে প্ল্যান করলাম গতবারতো সিলেটের জাফলং, সাদা পাথর, বিছনাকান্দি, রাতারগুল গিয়েছিলাম। এবার বান্দরবানে যেয়ে সেখান থেকে এক রাত থেকে কেওকারাডং যাব। তারপর যাব নাফাকুম যেটি বান্দরবানের একটি দুর্গম জলপ্রপাত। (সম্প্রতি নাফাকুমের পাশেই স্যাটেলাইট থেকে আল্লাহর নাম দেখা যাচ্ছে) সমুদ্র, ঝরনা, পাহাড়, নদী আর পাথরতো কম দেখিনি। এবার তাহলে নাফাকুমের দূর্গম জলপ্রপাত দেখা যাক।
হঠাৎ এক সকালে সবাই মিলে যাত্রা শুরু করলাম। সকালে রওনা দিয়ে রাতে পৌঁছলাম বান্দরবান শহরে। ভ্রমন ক্লান্তি নিয়ে ওখানে একরাত ছিলাম। সেখান থেকে পরদিন একটা গাড়ি ভাড়া নিই। গাড়িটি নীলগিরি পার হয়ে থানচিতে পৌঁছে। ওখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। অচেনা জায়গা হওয়ায় থানচি থেকে একজন গাইড ভাড়া করে নিই। এরপর ট্রলারে করে যাত্রা শুরু হলো।
ট্রলার চললো। নদীর দু’পাশে ছোট ছোট পাথর সজ্জিত। সেখানে দেখলাম ছোট বড়, সুন্দর, ভয়ংকর ও বিশাল বকৃতির রাজাপাথর। এখানে অনেকে এই রাজা পাথরকে পূজা করে। চলতে চলতে আরও দেখলাম নকশা করা কলসি পাথর। তীব্র স্রোত ছিলো নদীতে। নৌকা যেন স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে করেই আমাদের নিয়ে চললো। যখন রেমাক্রি পৌঁছলাম তখন বিকেল। রোমাক্রি হলো ছোট্ট একটি গ্রাম যেখানে আদিবাসীরা থাকে। তাছাড়া আছে মারমা, মুরংরাও। আমরা আশ্রয় নিলাম একটি মারমা পরিবারে যাদের ঘরটি ছিলো মাচায় বাঁধা। তারাই আমাদের রান্না করে খাওয়াল। অসাধারণ ছিলো তাদের সেই রান্না করা খাবার। রাতটা এখানেই কাটালাম।
পরদিন সকালে নাফাকুমের পথ ধরে চললাম। নাফাকুমের পথটি প্রথমে মজা লাগলেও পরে দেখলাম রাস্তাটি কঠিন থেকে আরও কঠিন হতে লাগল। পাহাড়ের খাড়া ঢাল। খাঁজে খাঁজে পা রেখে, আবার কখনও খাদের পাশে গাছে ঝুলে চলছিলাম। প্রায় চার ঘণ্টা হাটার পর দেখলাম কাঙ্ক্ষিত নাফাকুম। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রকৃতি নিজ হাতে তার অপরুম সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে এখানে। চারপাশে শুধু সবুজে সবুজ পাহাড়। মাঝখানে ছুটে চলেছে সাঙ্গু নদী। পাথুরে জলপ্রপাতে ছুটে চলেছে।
এরপর গাইডের তাড়া দিতে শুরু করলো। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে রেমাক্রিতে। আবারও সেই দুর্গম পথ। ফিরেও আসলাম। এসে দেখি খাওয়া তৈরি। খেয়ে ঘুম। এরপর আবারও একই পথে থানচি। থানচি থেকে বান্দরবান। তারপর বান্দরবান থেকে ঢাকা ফেরা। ঢাকায় ফিরলাম বটে। কিন্তু মনে রয়ে গেল নাফাকুমের ভয়ংকর গর্জন। সাঙ্গু নদীর স্রোতের সেই উন্মাদনা। সেই সাথে গাইড মামার সাথে দুষ্টুমিও।
এ ছিলো অচেনা, অজানা জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতা এখনো মন ছুঁয়ে যায়। উঠুক পাগলামি। এমন পাগলামি যে পাগলামিতে আবারও সফর হউক নতুন নতুন আরও অচেনা জায়গায়।