যেকোন সময়ের চেয়ে সন্ধ্যার বৃষ্টিটা নিধির কাছে মন খারাপের মনে হয়।কেমন যেন হতাশার একটা ভাব আছে,সন্ধ্যার গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে।সন্ধ্যার বৃষ্টিতে যে মনটা অস্থির অস্থির লাগে তার আরেকটি কারণ হতে পারে ঘরের লাইটের পাওয়ার।পাওয়ার অনেক কম তাদের বাসার লাইটের। অন্যান্য মেয়েদের কাছে এই বৃষ্টিটা হয়তো পছন্দের ও হতে পারে জানে না নিধি। বৃষ্টি নিধিরও পছন্দ।তবে তা হতে হবে দিনের বেলার বৃষ্টি, ঝুম বৃষ্টি।যে বৃষ্টির পর রংধনু দেখা যায়।আকাশে রং এর খেলা দেখতে নিধি পছন্দ করে।
তবে এই যে সন্ধ্যার মন খারাপ করা সময়…এই সময় টা ও মন্দ নয়।এই সময়টাতে সুদূর অতীতের কথা কানে বাজে।চোখে ভাসে অনেক বছর আগের কাটানো মুহূর্তের অস্থির সব স্মৃতি।মনে পড়ে বহু বছরের পুরনো চুড়ির ঝঙ্কার।চুড়িগুলো এখন ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার এ রং উঠে যাওয়া অবস্থায় পড়ে আছে।
এই সময়টা নিয়নের কথা মনে পড়ে।কি অদ্ভুত সুন্দর ছিল তাদের জীবন।প্রায়ই নিয়ন অফিস শেষে উপহার নিয়ে আসতো নিধির জন্য।নিধি নিষেধ করতো অনেক।তবুও কথা শুনতো না নিয়ন।
-“বলতো অফিস শেষে কি আনবো তোমার জন্য?”নিয়ন জিঙ্গেস করতো প্রতিদিন।
-“কিছুই আনতে হবে না।আপনি শুধু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসেন।একা থাকতে ভালো লাগে না আমার।”নিধি জবাব দিত।
কিন্তু নিয়ন কিছু না কিছু নিয়ে আসতোই।সবচেয়ে বেশি আনতো চুড়ি আর ফুল।প্রায়ই বলতো..”আমি তোমাকে বেশি কিছু দিতে পারি না কিন্তু অজস্র ভালোবাসা আর সম্মান দিতে পারবো।” সত্যিই পারতো নিয়ন।
তাদের সাজানো সংসার অনেক সুন্দর ছিল।কোনো অতিরিক্ত চাহিদা ছিল না,ছিল না পুরাতন প্রেমিকের কাছে ফিরে যাওয়ার টান,অতিরিক্ত কোনো আবদার ছিল না।
ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠার অভ্যাস কখনোই করে উঠতে পারেনি নিধি।কিন্তু মাঝে মাঝে দেখত নিয়ন নাস্তা তৈরী করছে তার আগে উঠেই।ছুটির দিনে তাকে রেধেও খাওয়াত নিয়ন।একবার যা হয়েছিল নিধির রান্না নিয়ে তা আর বলার নয়।
-“দেখেন তো আমার রান্নাটা কেমন হয়েছে?” রান্না করার পর নিধি জিঙ্গেস করেছিল।
-“সুন্দর”! তৃপ্তি করেই খেয়েছে নিয়ন।
কিন্তু একটু পর নিধি নিজে যখন খেতে গেল দেখলো রান্না খাওয়ার অযোগ্য হয়েছে অতিরিক্ত ভিনেগারের কারণে।আর সেটাই নিয়ন তৃপ্তি নিয়ে খেল নিধির কারণে।
তাদের সংসারে ঝগড়া হতো না কখনোই।তাই একবার তারা দুজন মিলে ঠিক করলো ঝগড়া দিবস উৎযাপন করা হবে।সেইদিন সব কিছু নিয়ে ঝগড়া করা হবে।
– আমি সবসময় মশাড়ি টাঙাই।আজ তুমি দিবে মশাড়ি।নিয়ন বললো।
-আমি ই তো সবসবয় দিই।ঝগড়া করার জন্য টপিক খুঁজে পাচ্ছেন না,তাই না?
অনেক হাসাহাসি হয়েছিল সেদিন।আর একবার শুধু ঝগড়া করার উদ্দেশ্যে নিধি বলেছিল,”আপনি ভিম দিয়ে থালা না মেজে গুড়া সাবান দিয়ে মাজলেন কেন?” সুন্দর ছোট্ট একটা সংসার বোধহয় এমন ই হয়।অনেক দিন পর হয়তো তারা তাদের আজীবনের বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিল।
নিয়ন একবার নিধির জন্য কদম ফুল এনেছিল।তার সবচেয়ে পছন্দের ফুল।কিন্তু নিয়ন জানতো না নিধির অ্যাল্যার্জী আছে কদম ফুলে।কদম ফুল হাতে নেওয়ার কারণে নিধির হাত ফুলে গেল।
-যে ফুল আমার সবচেয় পছন্দ সে ফুল হাতে নিলে তোমার হাত ফুলে উঠে!
কষ্ট পেয়েছিল অনেক নিয়ন।চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল।হয়তো কান্না চেপে রেখেছিল।মন খারাপ করে নিধির জন্য ওষুধ কিনে এনেছিল নিয়ন।
কিন্তু প্রকৃতি বোধহয় এত ভালোবাসা পছন্দ করে না।যে সংসারে ভালোবাসা থাকেনা,সে সংসারের মানুষগুলো থেকে যায় আজীবন।আর ভালোবাসায় গড়া সংসারের মানুষগুলো হঠাৎ হারিয়ে যায়।
এমনই এক অদ্ভুত বর্ষাকালের সন্ধ্যাবেলা ছিল সেদিন।কিন্তু ঝুম বৃষ্টি ছিল না।রংধনুও ছিল না।এমন এক মন খারাপ করা সন্ধ্যায় নিয়নের আলো নিভে গিয়েছিল!
একবছর ক্যান্সার এর সাথে যুদ্ধ করে মারা গেল নিয়ন।চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের জন্য নিধিকে একটি চাকরি নিতে হয়েছিল।অফিস শেষে হাসপাতালে দেখা করতে যেত নিয়নের সাথে নিধি।গিয়ে দেখতো ঘুমিয়ে আছে নিয়ন।কিন্তু তার বেডের পাশে নিধির জন্য ফুল না হয় চুড়ি রাখা থাকতো।অসুস্থ অবস্থায় ও নিধিকে উপহার দিত সে।
-কোথা থেকে জোগাড় করলে এসব?
-নার্সকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছি।
দুজন মিলে আবারও সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখত তারা।যেদিন নিয়ন মারা যায় সেদিন নিয়নের টেবিলের উপর নিধির জন্য রাখা ছিল কদম ফুল!!এই প্রথমবার নিধি কদম ফুলকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল,অ্যাল্যার্জী থাকার পরও!!!!!