ক্রিকেট তখনো পরিপূর্ন ছিলো অনেক রথী-মহারথী কিংবা অনেক বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাটসম্যান-বোলারদের পদচারণায়৷ ২২ গজের এক একটা বিস্তর উদ্যান কে প্রাণ এনে দেওয়া মহারথী কিংবা দল আগেও ছিলো এখনো আছে। কিন্তু এতো সবকিছুর ভিড়ে ক্রিকেট রাঙাতে এবং এর রঙে নিজেদের রাঙাতে ক্রিকেট আঙিনায় ১৯৮৬ সালে প্রথম পা রাখে বাংলাদেশ৷
শুরু টা রঙিন করতে না পারলেও, এতোদিন যাবৎ ক্রিকেট মঞ্চ কে রাঙানো সকল দল কে চোখ রাঙানো কিংবা নিজেদের পারফরম্যান্স দিয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্বে সমীহ জাগানো একেবারে নিয়মিত ছেলে খেলা বাংলাদেশের জন্যে। তবে কথায় আছে সুদিন দেখতে হলে দুর্দিনের সাথি হও আগে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সূচনায় দুর্দিন ছিলো নিত্য সঙ্গী। কিন্তু কথায় তো এটাও আছে বৃষ্টি শেষে আকাশ ঘুমড়া মুখ বেজাড় করে রাখে না বরং সাজে রংধনুর সাত রঙে। হ্যা অতীত কে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ ও এখন রংধনুর সাত রঙের মতোই স্বপ্ন বুণে ক্রিকেটের পরাশক্তি কে ধরাশায়ী করার। নিজের দিনে সেটা এখন কেবল বা-হাতেঁর খেল বাংলাদেশের জন্যে।
কিন্তু এখন প্রশ্ন করতে পারেন এমন বাংলাদেশের পিছনে শুরু টা ট্রাজিক কোনো ঘটনা আছে কি? হ্যা অবশ্যই শুরু টা ট্রাজিক। একটা টেস্টে জয়ের জন্যে আমাদের লেগেছে দীর্ঘ ৫ বছর এবং ৩৫ টি টেস্ট ম্যাচ। আপনি জেনে অবাক হবেন যে বাংলাদেশের চেয়ে দ্রুত সময়ে নিজেদের প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়ছে ৫ টি দল আর বাকি সবাই বাংলাদেশের থেকে ডের পিছিয়ে। ৫ বছরের অপেক্ষার প্রহর শেষে অবশেষে সূর্যি মামা উদয় হয় এদেশের ক্রিকেটে। আজকে প্রয়াস থাকবে গল্পে গল্পে জানান দেওয়া বাংলাদেশের অর্জনে ১ম টেস্ট জয়ের ট্রাজিক গল্প;
আভিজাত্য আর গৌরবের ক্রিকেট ফরম্যাট টেস্ট। আভিজাত্যের গল্প টেস্ট কিংবা এর ঐতিহ্যে বাংলাদেশের সূচনা ২০০০ সালে। তবে গল্পের সূচনা একটা নতুন লেখকের ব্যর্থতার একটা শিরোনামে। ব্যার্থ শিরোনামের অতলে গল্পের পাঠকরা চরম উৎকন্ঠা এবং উত্তেজনায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলো ভালো কিছুর প্রত্যাশায়। কিন্তু ব্যর্থ সেই শিরোনামের আড়ালে চলে যায় ৫ টি অধ্যায়, (৫বছর)। প্রতিটা অধ্যায়ে ছিলো ৩৬৫ দিনের এক একটি মহাকাব্য। অনেকবার গল্পে ছিলো ভালো কিছুর লক্ষন কিন্তু তা শেষ হয়েছে একরাশ হতাশা আর ব্যর্থতায়৷ অবশেষে এলো সময় কিন্তু এবার প্রতিপক্ষ ভিন্ন কিন্তু ডেরা ছিলো নিজেদের!
২০০৫ সালের ৬ জানুয়ারি তখন শুরু হয় বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ২ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের ১ম ম্যাচ৷ এর আগে ৩৫ টেস্ট খেলা বাংলাদেশের ঝুলিতে তখনো পড়েনি কোনো জয়। ভাগ্য দেবীর অশেষ কৃপায় হয়তোবা সেদিন নতুন লেখক ভালো কিছুতে অভিষেক করতে যাচ্ছিলো।
টস ভাগ্যে জয় লাভ করে ব্যাটিং বেচে নেয় বাংলাদেশ দলপতি হাবিবুল বাশার সুমন। সময়ের প্রত্যাবর্তনে অধিনায়কের সেই সিধান্তের যথার্থতা প্রমাণে মোটেও কালক্ষেপন করেনি একাদশের গোড়াপত্তন থেকে একাদেশের শেষ ব্যাটসম্যান পর্যন্ত। সূর্য উদিত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, ম্যাচের প্রতিটা সেশনে ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদয় বিদারী সব উদযাপনে মেতেছিলো চট্টগ্রামের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম। মাঠের প্রতিটা দর্শক থেকে শুরু করে প্রতিটা কনা অব্দি সেজেছিলো নতুন সাজে টাইগারদের বিজোয়োল্লাসের সঙ্গী হবে বলে!
চলুন ফিরে যাওয়া যাক ম্যাচে; বল হাতে প্রস্তুত ছিলেন জিম্বাবুয়ান বোলার এমপিফু৷ ব্যাট হাতে বাংলাদেশের ডেরা থেকে বেড়িয়ে আসলেন জাভেদ উমর বেলিম এবং তরুন নাফিস ইকবাল দুই টাইগার৷ প্রথম বল করলেন জাভেদ উমর দেখে শুনে ছেড়ে দিলেন, কোনো রান আসেনি প্রথম বল থেকে।
এভাবে পুরো ৩৬ ওভার পর্যন্ত মাঠের চারদিকে স্ট্রোকের ফুলঝুড়িতে রানের পাহাড়েত ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন বাংলাদেশী দুই অপেনার৷ দলীয় ৩৬ ওভার শেষে চিকুম্বুরা এর বলে কট-বিহাইন্ড এর ফাদেঁ পা দিয়ে ফেলেন জাভেদ উমর বেলিম। এরপর একটু রয়েশয়ে নাফিস ইকবাল হাফসেঞ্চুরি করলেও ৪০ তম ওভারে ১ বলে নাফিস ইকবাল ব্যাক্তিগত ৫৬ রানে প্যাভিলিয়ন পাড়ি জমান।
অধিনায়ক হাবিবুল বাশার এবং মোহাম্মদ আশরাফুল এরপর শুরু করে ইনিংস মেরামতের কায়াজ৷ ব্যাক্তিগত ১৯ রানে আশরাফুল বিদায় নিলেও হাবিবুল বাশার থেমেছেন শেষ পর্যন্ত ব্যাক্তিগত ৯৪ রানে। বাংলাদেশ অল-আউট হয় ৪৯৮ রানে৷ ৪৯৮ রানের মাঝে বাংলাদেশের টপ-অর্ডার থেকে লোয়ারঅর্ডার সবাই মাতিয়েছেন স্টেডিয়ামের পুরো মানুষ কে। আর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটপ্রেমীরা নিজেদের জানান দিচ্ছিলো গগনবিদারী চিৎকারে৷
৪৯৮ রানর ট্রাজিক ইনিংসে বাংলাদেশ পার করে দিয়েছে ২ দিনের ২ সেশন। রাজিন সালেহ ৮৯, মোহাম্মদ রফিকের ৬৯ এবং খালেফ মাসুদ পাইলট ও মাশরাফির ৪৯ এবং ৪৮ রানের সুবাদে বাংলাদেশের ইনিংসের ক্রান্তিলগ্ন আসে ২ দিনের চা চুমুকের বিকালে৷
পড়ন্ত বিকালে জিম্বাবুয়ের কাধেঁ তখন হিমালয় সম রানের বুঝা। ২ ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে জিম্বাবুয়ান দুউ উদ্ভোদনী ব্যাটসম্যান রগার্স এবং মাস্তিকেনিয়ারি আসে ২২ গজে৷ ২ দিনের পড়ন্ত বিকালে ব্যাটে বলে লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী হয় ২৮ ওভার পর্যন্ত। বেলা শেষে ১৬৮ বলে লড়াইয়ে পরাস্ত হয় জিম্বাবুয়ান ৪ ব্যাটসম্যান৷ সংগ্রাহের হিসাব নিকাশের খাতায় তখন জিম্বাবুয়ের ৮৪/৪৷ তাপস বোস এর ১ টি, মোহাম্মদ রফিকের ঘূর্নির কবলে ২ টি এবং রান আউটের কল্যানে বেশ ভালো ভাবে শেষ করে দিন টেস্টের ২য়।
২য় দিনের চা বিকালে মোহাম্মদ রফিকের স্পেলের রেশ টা যেনো ৩য় দিনের সকালেই টেনে আনলেন মাশরাফি। ৩য় দিনের খেলা সবে ২.২ গড়িয়েছে। ৩য় ওভারের ৩ বলে হেমিলটন মাসাকাদজা কে লেগ-বিফোর এর ফাঁদে ফেলতে বাধ্য করেন মাশরাফি। জিম্বাবুয়ের স্কোর তখন ৮৬/৪। দলীয় ২ রান যোগ করতেই জিম্বাবুয়ে হারায় নিজেদের ৫ম উইকেট। হেমিলটন মাসাকাদজা বিদায় নেন ২৯ রানে।
এরপর রয়ে সয়ে খেলতে থাকে জিম্বাবুয়েন দুই ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেইলর এবং টাইবো। ইনিংসের
৬১ তম ওভারে আবারো মাশরাফির বলে লেগবিফোরের ফাঁদে পড়েন ব্রেন্ডম টেইলর। ব্যাক্তিগত ৩৯ রানে বিদায় নেন ব্রেন্ডন টেইলর। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে জিম্বাবুয়ে অল-আউট হয় ৩১২ রানে। মোহাম্মদ রফিক শিকার করেন ৫ উইকেট এবং মাশরাফি শিকার করেন ৩ টি করে উইকেট৷
১৭৬ রানে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশ ম্যাচের ৩য় ইনিংসে এবং নিজের ২য় ইনিংসে আবারো ব্যাট করতে নামে। নিজেদের ২য় ইনিংসে মাত্র স্থায়ী হয় ৫১ ওভার। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে ৫১ ওভারে বাংলাদেশ ইনিংসে যখন ঘোষনা করে তখন বাংলাদেশের হতে ছিলো মাত্র ১ উইকেট এবং ঝুঁলিতে ২০৪ রান। ১ম ইনিংসের মতো ২য় ইনিংসেও রানের তালিকায় উপরে ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। প্রথমে ইনিংসে ৯৪ রানের পর ২য় ইনিংসে করেছেন ৫৫ রান। এছাড়াও রাজিন শালেহ এর ২৬, পাইলটের ২৩ এবং মোহাম্মদ আশরাফুলের ২২ রানের উপর ভর করে বাংলাদেশ দাড়ঁ করায় ২০৪ রান।
৪র্থ দিন বিকালে যখন জিম্বাবুয়ে ব্যাটিং এ নামে তখন জিম্বাবুয়ের ঘাড়ে ৩৮০ রানের বিশাল পাহাড়সম লক্ষ্য। ৩৮০ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৪র্থ দিনের বিকালেই ৩ উইকেট হারায় জিম্বাবুয়ে৷ ৫ম দিনেত সকালে হার মানা মনোভবে উইকেট শুধুমাত্র নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে গেছেন জিম্বাবুয়ান ব্যাটসম্যানেরা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে মাত্র ৬২ ওভারে দলীয় ১৫৪ রানে অল-আউট হয় জিম্বাবুয়ে। দলের হয়ে ৪র্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান করেন হ্যামিলটম মাসাকাদজা (৫৬)। এছাড়া প্রথম ইনিংসে কোনো উইকেট না পাওয়া এনামুল হক জুনিয়র শিকার করে ৬ টি উইকেট। মাশরাফি এবং তাপ্যস বোশ ২ টি করে উইকেট শিকার করেন। ফলস্বরূপ ম্যাচ সেরার পুরষ্কার হাতে উঠে এনামুল হক জুনিয়র এর।
- টেস্ট ফরম্যাটে বাংলাদেশের মোট জয় ১৪ টি। ১৪ জয় আসার পিছনে একটা দিন বিশেষ স্পেশাল। সেটা প্রথম টেস্ট জয়৷ ২০০৫ সালে ৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া টেস্টে এসেছিলো বাংলাদেশের ১ম টেস্ট জয়ের দুঃখ গোচাতে। দেশের প্রতিটা জয় স্পেশাল কিন্তু প্রথম জয় ছিলো বেশি স্পেশাল। তার প্রমাণ ম্যাচের ৫ টা দিনে স্টেডিয়ামে ক্রিকেট প্রেমীদের উচ্ছাস। এমন অনেক জয়ে বাংলাদেশেত ক্রিকেটপ্রেমীদের রাঙানোর জন্যে শুভকামনা টাইগারদের জন্যে!!