শিশুশ্রম আমাদের দেশে খুবই অপ্রিয় একটি বাস্তবতা হলেও এটাকে আইন করে বন্ধ করে দেওয়ারও উপায় নেই। অনেক শিশুই আছে। | যারা কাজ না করলে তাদের ক্ষুধার্ত থাকতে হবে। তবে, এই | বাস্তবতাকে মেনে নিয়েও আমরা ওদের জীবনটাকে আরেকটু সুন্দর করতে পারি। এবং এর শুরুটা হতে হবে আমাদের আচরণ থেকে। | কোনাে হােটেলের বয় বা বাস-টেম্পাের হেলপার ভার্সিটির ফুল বিক্রেতা যখন একটু কম বয়সী কোনাে ছেলে বা মেয়ে হয় তখন | তাদের প্রতি আমাদের আচরণটা একটু অদ্ভুত হয়। আমরা খেয়াল করি না, কারণ আমরা মনে মনে ভাবি এ রকমই তাে হওয়ার কথা। আপনি যখন আপনার কোনাে বন্ধুর সন্তান বা ছােট ভাইবােনকে প্রথমবারের মতাে দেখেন, তখন তাকে ‘পিচ্চি’ বা ‘ছােটু বলে ডাক দেন? বা ওকে শিস দিয়ে ডাকেন? কিন্তু যখন আমরা এই সব কর্মজীবী শিশুকে ডাক দিই আমরা কিন্তু এই শব্দগুলােই ব্যবহার করি। আপনি আপনার অপরিচিত কোনাে শিশুকে ‘তুই’ বলে সম্বােধন। করেন? অথচ বাসের হেলপার হােটেলের বয়কে কিন্তু প্রায়শই আমরা “তুই’ ডাকি। শুধু সম্বােধন না, ওদের সাথে কথাবার্তাও কেমন | যেন রুক্ষ হয়। ফুল বিক্রি করা মেয়েটাকে ‘যা, ভাগ এইখান থেকে, টেম্পাের হেলপার ছােট ছেলেটা একটু বেশি ভাড়া চাইলে এই বয়সে চুরি শুরু করছস?’ এ ধরনের নানা কথা আমাদের নিজের কানে শােনা। আমরা হয়তাে এই কথাগুলাে কিছু না বুঝেই বলি।
অথচ চিন্তা করুন, এই বাচ্চাটা জীবনে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে একদিন বড় হবে। এই সমাজে আমাদের মতাে যত মানুষ আছে তাদের প্রতি একটা ঘৃণা নিয়ে বড় হবে। ওর মনের মধ্যে থেকে যাবে যে এই সমাজের লােক সব সময় একে অপমান আর অবজ্ঞা করে এসেছে। কেউ এর প্রতিশােধ নিতে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়বে কেউবা নিজেই রুক্ষ একটা মানুষ হয়ে উঠবে আর ওর আশপাশের মানুষের সাথেও খারাপ ব্যবহার করবে। অর্থাৎ প্রতিটি শিশুর সাথে আপনি যখন রুক্ষ আচরণ করেন, তখন আপনি ভবিষ্যতের একজন বদমেজাজী মানুষের জন্ম দেন।
অথচ এর সমাধানটা কিন্তু খুব সহজ। আমার বন্ধ ইয়াসিন আমাকে | খুব সহজ একটা পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছে। ও কোনাে হােটেলে এ রকম কোনাে শিশুশ্রমিককে দেখলে বলে, এই যে বাবু, শােনাে তাে। বাচ্চাটা খুব অবাক হয়ে কাছে আসে। ইয়াসিন আবার জিজ্ঞেস করে, “তােমার নাম কী?’ এই পর্যায়ে বাচ্চাটা হেসে দেয়। নরম করে নামটা বলে, ইব্রাহিম। ইয়াসিন বলে ইব্রাহিম, এককাপ চা নিয়ে আসাে তাে আমার জন্য। বিশ্বাস করুন, ছেলেটা খুব খুশি মনে চা আনতে যায়। এটা ওর কাছে আর কাজ মনে হয় না, মনে হয় আপন কেউ চা খেতে চেয়েছে, তাকে চা খাওয়াতে হবে। খাবার। অর্ডার করার পর ইব্রাহিমকে কয়েকবার নাম ধরে ডেকে এটা-ওটা চাওয়া হলাে। ও একদম বিরক্ত হলাে না। বরং যে কয়বার ওর নাম। ধরে ডাকা হলাে, ওর চোখ-মুখে একটা ঔজ্জ্বল্য দেখলাম। ওকে নাম ধরে ডাকলে ও এত খুশি হয় কেন জানেন? ওর নামটা ওকে একটা পরিচয় দেয়। একটা আত্মমর্যাদা দেয়। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও ওর মনে হয় ও একজন হােটেল বয়ের থেকে বেশি কিছু, একজন শিশুশ্রমিকের থেকে বেশি কিছু। ও ইব্রাহিম। ওর নিজের একটা। পরিচয় আছে।
আমাদের পথশিশুরা, আমাদের শিশুশ্রমিকেরা একটু শিক্ষা পেলে ভালাে মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। ওরাও ভবিষ্যতের দক্ষ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। আর আমার আর আপনার ভালােবাসা পেলে ওরা ‘পিচ্চি’ বা ‘ছােটু’ না হয়ে একেকজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।। একটা বাড়তি টিপস: আপনি যদি সবার প্রিয় হয়ে উঠতে চান, তাহলে এখন থেকেই অভ্যাস করুন সবার নাম মনে রাখার, আর কথা বলার সময় শ্রোতার নামটা বলার। কারণ, প্রত্যেক মানুষের কাছে তার সবচেয়ে প্রিয় শব্দ হলাে তার নাম। আপনি যদি একজন মানুষের নাম মনে রাখেন এবং তার সাথে কথা বলার সময় সেটা ব্যবহার করেন তাহলে একটা সময় সেই মানুষটা নিজের অজান্তেই আপনার ভক্ত হয়ে যাবে। কাল থেকে রিকশাওয়ালা মামা, দোকানদার মামা, দারােয়ান মামাকে শুধু মামা না বলে তাদের নামটা জেনে নামের সাথে মামা যােগ করে সম্বােধন করুন। আর দেখুন কী আপ্যায়নটাই না পেয়ে যান!