বাদুড় এমনই এক প্রাণী যে কিনা দিনের আলোয় কাউকে মুখ দেখায় না। পাছে কেউ দেখে ফেলে তাই গাছের ডালে পাতার ভিড়ে মুখ আড়াল করে ঝুলে থাকে। দিনের শেষে সূর্য যখন ফেলে বসে, আলো মিলিয়ে গিয়ে আকাশ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে, বনের পাখিরা সারাদিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে তাদের বাসায়, বাদুড়েরা সেই সময় আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তাদের অনেক কাজ রাতের অন্ধকারে করতে হয়।
বাদুড়েরা কেন দিনের আলোয় সবার সামনে বেরিয়ে আসতে লজ্জা পায় সেই ঘটনা বলছি। অনেক দিন আগের কথা। সেই সময় বাদুড়েরা ও অন্য সব পাখিদের মত দিনের আলোয় ঘুরে বেড়াতো। একবার হল কি, বনের পশু এবং পাখিদের মধ্যে কি নিয়ে যেন লড়াই বেঁধে গেল। পাখিরা সুযোগ পেলেই নানাভাবে পশুদের উপর আক্রমণ করে এবং নাজেহাল করার চেষ্টা করে। আবার পশুরাও পাখিদের ওপর পাল্টা চড়াও হয়। এক কক্ষ থাকে গাছের উপরে। অন্যদল মাটিতে। তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। নিজের দলের সম্মান বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ লড়াই করে চলল দুই পক্ষই।
বাদুর কিন্তু কোন পক্ষেই যোগ দিলো না। সে গাছের মগডাল থেকে নিচের দিকে মুখ করে ঝুলে থাকে এবং দেখতে থাকে লড়াইয়ের ফলাফল টা কি দাঁড়ায়। অনেকদিন লড়াই চলার পর শেষ পর্যন্ত পাখিরা গেল হেরে। জয়ী জন্তুরা আনন্দ করতে লাগলো। সুযোগ বুঝে বাদুড় এবারে উড়ে গিয়ে পশুদের সঙ্গে যোগ দিল। বাদুর কে পাখি বলে জানে জন্তুরা। কারণ সে অন্য পাখিদের মতো গাছের ডালে বাস করে। আর আকাশে ওড়ার জন্য দুটো ডানা ও তার আছে। তাই বাদুর কে দলে ভিড়তে দেখে জন্তুদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। হেরে গিয়ে পাখিরা লজ্জায় গাছের পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। আর বাদুর কিনা জন্তুদের সঙ্গে মিশে আনন্দ করছে। কারণটা জন্তুরা বুঝে উঠতে পারছিল না।
তাই সকলেই তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। জন্তুদের মনের ভাব কিন্তু বুঝে উঠতে দেরী হলো না বাদুড়ের।সে তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য তখন বলল , ভাইসব আমিও তোমাদেরই দলের একজন । গাছে আমাকে থাকতে হয় বটে , তবে পাখিদের মতো খড়কুটো দিয়ে আমাকে ঘর বাঁধতে হয় না । তোমাদের মতো আমার বাচ্চাও আমার বুকের দুধ খেয়েই বড় হয় এরপর নিজের কান দুটি দেি সে বলল , এই দেখো , তোমাদের মতোই কান আমার । গায়েও কোনও পালক নেই – আমার শরীর মোলায়েম লোমে ঢাকা ৷ ডানা দুটো দেখো ; চামড়ায় মোড়ানো । আর এই দেখো আমার চোয়াল , তোমাদের মতো ধারালো দুসারি দাঁত বসানো । পাখিদের সঙ্গে পাশাপাশি থাকি এই যা সম্পর্ক । আসলে তোমরাই হলে আমার জাতভাই । আমি পাখি নই , পশু । বাদুড়ের কথা শুনে পশুরা মাথা নেড়ে সায় না দিয়ে পারল না । তারা বুঝতে পারল , বাদুড় কিছু মিথ্যা বলেনি । তারাই এতদিন ভুল জেনেছে । আসলে বাদুড় পাখিদের কেউ না , সে তাদেরই দলের একজন । তাই আজ তাদের সঙ্গে আনন্দ করার হক তারও আছে । পশুরা খুশি হয়ে বাদুড়কে দলে টেনে নিয়ে আনন্দ করতে লাগল । লড়াইয়ের বেশ কিছুদিন পরে দুপক্ষের মধ্যে রেষারেষি দূর হল । আবার আগের মতোই পশুতে আর পাখিতে মেলামেশা চালু হল ।
কিন্তু বেশি দিন এই অবস্থা বজায় থাকল না । আবার একদিন সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে বেঁধে গেল ঘোরতর হানাহানি । আগের বারের অবস্থাই ফিরে এল ফের ।বাদুড় এবারেও গিয়ে গাছের আগডালে পাতার আড়ালে গা ঢাকা দিল । কোনও পক্ষেই যোগ দিল না । ফলাফলটা কী দাঁড়ায় তার জন্য অপেক্ষা । দিন কতক লড়াইয়ের পরই এবারে পশুরা হার মানতে বাধ্য হল । পাখিরা জয়ী হল । জয়ের আনন্দে গাছে গাছে পাখিদের আনন্দের হাট বসে গেল । আর জতুরা ? হেরে গিয়ে লজ্জায় কেউ পাহাড়ের গুহায় , কেউ ঝোপের ভেতরে মুখ লুকিয়ে বসে রইল । সুযোগ বুঝে বাদুড় গিয়ে পাখিদের সঙ্গে যোগ দিল । কিন্তু সে দেখল পাখিরা তাকে এড়িয়ে থাকতে চাইছে আর কেমন সন্দেহের চোখে পাখিদের মনের ভাব বুঝতে পেরে বাদুড় তাদের ডেকে বলল , ভাইসব , তোমরা কী আমাকে চিনতে পারছ না ?
আমি যে তোমাদের দলেরই একজন । তোমাদের সঙ্গেই তো গাছের ওপরে পাশাপাশি থাকি । তোমাদের মতো আমার ডিম হয় না বটে , তাতে কী , তোমাদেরই মতো দুটো ডানা তো আমারও রয়েছে । তা দিয়ে খুশি মতো আকাশে উড়ে বেড়াই । দুসারি দাঁত অবশ্য রয়েছে আমার মুখে । তবে তা দিয়ে তো পশুদের মতো হাড় মাংস চিবিয়ে খাই না । গাছের ফলমূলই আমার খাদ্য । আমি তাই তোমাদেরই আপনজন ।বাদুড়ের কথা শুনে পাখিরা ভাবল , তাই তো , বাদুড়কে আমরা মিছেই সন্দেহ করছি । সে তো পাখিই বটে । তখন বাদুড়কে দলে টেনে নিয়ে পাখিরা আনন্দ করতে লাগল । এক এক করে দিন কাটতে লাগল । কিন্তু জন্তুরা কতদিন আর মুখ লুকিয়ে থাকবে ? কিছুদিন পরে তারা নিজের নিজের কাজে বেরুতে শুরু করল । আর তখনই তারা আশ্চর্য হয়ে দেখল বাদুড় দিব্যি পাখিদের সঙ্গে মিশে আনন্দ করছে । দেখতে দেখতে খবরটা পশুদের মহলে ছড়িয়ে পড়ল । বাদুড়ের অভিসন্ধি বুঝতে তখন আর কারোরই বাকি থাকল না ।
পরিচয় ভাঁড়িয়ে সে তাদের প্রতারণা করেছে । অল্প দিনের মধ্যেই বনরাজ্যের অবস্থা আবার শান্ত হয়ে এল । পশু আর পাখিদের মধ্যে ভাব ভালবাসাও ফিরে এল । বাদুড়ের কীর্তিকলাপের কথাটা এবারে কারও কাছেই গোপন রইল না । পাখিদের কানেও পৌছল । প্রতারক বাদুড়ের স্বভাব জানতে পেরে পাখিরাও সাবধান হয়ে গেল । ছিল কানাঘুষা।এবারে দুপক্ষেই বাদুড়কে নিয়ে শুরু হয়ে গেল জোর আলোচনা । সব শেষে পশু আর পাখিরা মিলে একদিন বসল সভা করে । তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করল , বাদুড়ের মতো দুমুখো প্রাণীকে কোন পক্ষেই থাকতে দেওয়া হবে না ।
মওকা বুঝে নিজের আসল পরিচয় গোপন করতেও তার বাধে না । সে পশুও নয় , পাখিও নয় । তবে সে যে কোন শ্রেণীর জীব তা তারা কেউ ঠিক করতে পারল না । তবে কিনা , যার পরিচয় ঠিকভাবে জানা যায় না , তার সঙ্গে মেলামেশা নিরাপদ নয় ৷ পশু ও পাখিরা বাদুড়কে ডেকে জানিয়ে দিল এখন থেকে সে কোনও পক্ষেরই কেউ নয় । সেই দিন থেকে সেই যে বাদুড় লজ্জায় পাতার আড়ালে মুখ লুকোয় সেই মুখ আর দিনের আলোয় কাউকে দেখায় না ।