আমার জীবনে এমন অনেক ছোটো ছোটো কাহিনী আছে যেগুলো হঠাৎ স্মরণে এলে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। ঘটনাগুলো ছোটো ছোটো হলেও এর মাহাত্ম্য ও অনুভূতি অন্তরে বেদনার আঁচড় কাটে।
কিছু করতে না পেরে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। বিস্তৃত খোলা এই পৃথিবী আমার কাছে ছোটো ও সংকুচিত মনে হয়।
এইরকম একটা কাহিনী আজ আপনাদের কাছে জানাবো। এর গভীরতার পরীক্ষা আপনারা করবেন। সময় খুব অল্প, কিন্তু জীবনের সফর অনেক লম্বা।
আমি বিয়ে করেছি এক বছরের বেশি হলো। একটি ৬-৭মাসের ছেলে আমার। ছোট হলেও অনেক দুষ্টু, সারাক্ষণ কোল থেকে নেমে খেলোধুলা করে খেলনাপাতি দিয়ে।
ঘটনাটা যেসময়টাতে ঘটে তখন আমি ঢাকার ভেতর ছোটো খাটো একটা কাজ করি। সংসার ছিলো ছোটো তাই খরচও অনেক কম। ছোট্টো চাকরিতে যোগ দিয়ে সংসারের হাল ধরেছি, সব কোনোমতে চলে যেতো।
তো একদিন আমি শুক্রবার বিকেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। শুক্রবার ছুটির দিন ছিলো। অফিসে কাজের চাপ খুব কম।
তাই সবার সাথে মুক্তমেজাজে একটু ঘোরাঘুরি। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ এলাকার মধ্যে ছোটো জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে। ঘুরে দেখলাম ইকোপার্ক, শিশুউদ্যান, নাগরদোলা, চিড়িয়াখানা। সবশেষে দেখলাম সদরঘাটের স্টিমার ও জাহাজভরা ঘাটের ব্যাস্তচিত্র। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।
মাগরিবের আজান দিতে আর ১০-১৫ মিনিট বাকি আছে। রাস্তার মোড়ে এসে দেখি মাঝারি সংগ্রহের ছোটো একটা খেলনার দোকান। বৃদ্ধ বয়সের এক দোকানি বসে আছে। বয়স প্রায় ৬০-৭০ এর উপর হবে।
ছেলে খেলনার দোকানের দিকে ইশারা করে বলল তার একটা খেলনা চাই। কিন্তু বাসায় অনেক খেলনা আছে ভেবে আমি বললাম, “বাবু, বাসায় তো তোমার অনেক অনেক খেলনা আছে। বাসায় চলো, গিয়ে ওগুলো দিয়ে খেলবে। ”
কিন্তু, ছেলে কিছুতেই মানবেনা। লাল রংগের একটি রিমোট কন্ট্রোল উড়োজাহাজ ছিল, ওইটাই ওর পছন্দ হয়েছে। রাস্তায় লোকের ভিড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, বিরক্ত হয়ে ওর মাকে বললাম ওকে সামলাতে।
ওর মা উল্টো আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল”কিনে দিলে কি এমন হবে? তাছাড়া তোমার ঐ জেদি ছেলেকে কে চুপ করাবে? রাস্তায় এই ঝামেলা কি ভালো লাগবে তোমার? ”
ওর পাল্টা প্রশ্ন শুনে আমারই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অগত্যা দোকানের সামনে এগুলাম। আমাদের দেখতে পেয়ে বৃদ্ধ বয়সের মানুষটি একগাল হেঁসে বললেন “আসুন স্যার, কি লাগব আপনার বাচ্চার লাইগা? ”
স্যার? কে স্যার? , মনে মনে বললাম, আমাকে কি স্যারের মতো লাগে? গায়ের দিকে চেয়ে দেখি আমার ড্রেসআপ দেখে ওইরকমটাই ঠাওর হয়। শার্টের সাথে প্যান্ট ইন, জুতো মোজা।
ভাবলাম, লোকটা আমার সত্যিকার অবস্থা যদি দেখতো, তাহলে কি স্যার বলতো? এমনিতে আমি অফিসে আমার উর্ধ্বতনকে স্যার ডাকি। এখানে কিনা উনি আমাকে স্যার ডাকছেন! মনে মনে একটু লজ্জা পেলাম।
আমি ওনার কথায় কান না দিয়ে আমার ছেলেকে তখনও বুঝাচ্ছি, বাসায় তো তোমার অনেক অনেক খেলনা আছে, বাবু। ওগুলো দিয়ে খেলবে চলো!
ও কান্না করছেই।
ওর কান্না শুনে বৃদ্ধ বয়সের মানুষটি যা বললো তাতে আমার মনের পাড়ায় তোলপাড় ভূমিকম্প শুরু হলো।
“নিন না স্যার, নিয়ে নিন না স্যার। আমারও ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে, দেশের বাড়িতে। আপনার বাচ্চা খেললে আমার বাচ্চা খাইতে পারবে, স্যার। নিয়ে নিন না খেলনাটা!
কথাগুলো সোজা অন্তর ভেদ করে চলে গেছে। আমি কোনোমতে চোখের জল সামাল দিয়ে হা হয়ে আমার স্ত্রীর প্রতি তাকিয়ে আছি। ও ইতিমধ্যে চোখের পানি মুছতে শুরু করেছে। কয়েক মুহূর্ত কি হলো বুঝলাম না। কথাগুলোর মধ্যে এতোটাই অনুভূতি ছিলো যে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। আমি ছেলেটাকে নামিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কোলে তুলে নিলো। বললাম আপনার ছেলে নেই? এই বয়সেও ব্যাবসা করেন?
বললো ” আমার বড়ো ছেলের বয়স আপনার মতো হইব, ওর একটা ছেলে আছিল এইরকম দেখতে।
আমার আরো ছোটো ছোটো দুইটা ছেলে আছে, বয়স ৭-৮ বছর হইব। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়া দিসি। ওরও ছেলে মেয়ে আছে।
কিন্তু আমার আর আমার বউয়ের ভাড় সইতে না পাইরা বড়ো ছেলে আলাদা হইয়া গেছে।
ওর বউয়ের নিষেধ ছিলো যাতে আমাগো না দ্যাহে।
তাই এই বয়সেও ব্যাবসা করতে হয়। ”
খেলনাটা কিনলাম, দাম ২৫০ টাকা। আমি ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম “বাকিটা আপনি রাখেন। ”
উনি বললেন”স্যার, লাগবো না। আমরা মেহনত কইরা খাই, এমনি টাকা নিমুনা।
ওনার উত্তর শুনে মুহূর্তেই আমার মানবতার প্রাচীর ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। মানবতা দেখাইতে গেছিলাম, উল্টা আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলো।
কথা শুনে মনে হলো নাজানি দুনিয়ায় এনার মতো আরো কতো অসহায় বাবা মা আছে! অসহায় বলতে মূলত অকৃতজ্ঞ ছেলে ও তাদের বউয়ের জন্যে।
তবে ঐ দিন বাড়ি ফিরে বেশ কয়েক ঘন্টা নির্বাক ছিলাম, কারো সাথে কথা বলা হয়নি।
আমার স্ত্রী পাশে এসে বসল। বললো”দুনিয়াটা অনেক বড়ো। নাজানি ঐ লোকটার মতো আরো কতো মানুষ আছে!
তুমি কি সবার জন্য দুঃখ করতে পারবে? বা সবার জন্য আবেগ অন্তরে পুষতে পারবে? অতএব দুঃখ করে লাভ নেই, শুধু দোয়া রইল তার জন্য। ”
বউয়ের এইরকম জ্ঞানীর মতো কথা শুনে ভাবলাম আসলেই তো তাই। শুধু দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আমরা কিই বা করতে পারি? তবে যখনই এই কথা মনে হয়, নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।