ধানের মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট অন্যতম।প্রায় বিশ্বব্যাপী এর বিস্তৃতি।গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের প্রকরণটি শীতপ্রধান অঞ্চলের প্রকরণ অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকারক।জাপানের কৃষকেরা সর্বপ্রথম এ রোগের সন্ধান পান বলে ধারণা করা হয়।টাকায়েসি ১৯০৮ সালে সর্বপ্রথম প্রমান করেন যে, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগটি হয়।
রোগজীবানু : ধান গাছের ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট নামক রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার নাম Xanthomonas oryzae pv. Orayzae Swings et al.এটি দণ্ডাকৃতির ১.২×০.৩ – ০.৫ মাইক্রোমিটার,অপেক্ষা কৃত মোটা ও খাটো ।এরা সাধারণত একক ভাবে থাকে। আবার কখনো দুইটি এক সাথে থাকতে পারে, তবে চেইন সৃষ্টি করেনা।এরা গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া এবং স্পোর সৃষ্টি করতে পারে না।এদের কোন ক্যাপসিউল নেই।তবে একটি ফ্ল্যাজেলাম থাকে।
অ্যাগার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া গোলাকার,মসৃণ,
মোমের ন্যায় হলুদাভ ও চকচকে কলোনি উৎপন্ন করে।এরা বিভিন্ন ঘাস ও বন্য ধানকে বিকল্প পোষক হিসেবে গ্রহণ করে বেচে থাকে।
রোগাক্রমন : একাধিক উৎস থেকে রোগাক্রমন ঘটতে পারে। যেমন-রোগাক্রান্ত বীজ, রোগাক্রান্ত খড়,জমিতে পরে থাকা রোগাক্রান্ত শস্যের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি ।পাতার ক্ষত স্থান,কাটা স্থান,
পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে জীবানু গাছের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সেখানে সংখ্যাবৃদ্ধি করে।পরে জীবানু শিরার ও অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।মূলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং গাছ নেতিয়ে পড়ে ।অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রা (২৫-৩০° সে.),উচ্চ জলীয় বাষ্প, বৃষ্টি,জমিতে অধিক পানি রোগাক্রমে সহায়তা করে। অধিক পরিমাণ সার প্রয়োগও রোগ বিস্তারের অনুকূল হয়।ঝড়ো বাতাস পাতায় ক্ষত সৃষ্টি করে থাকে,আর ঐ ক্ষত স্থান দিয়ে রোগজীবানু ভেতরে প্রবেশ করে ও রোগ সৃষ্টি করে।
রোগ লক্ষণ :
সাধারণত রোগ লক্ষণ পাতায়ই সীমিত থাকে।লক্ষণসমূহ নিম্নেদেয়া হল:-
১) সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের মদিকে এ রোগের সূচনা হয়।
২) পাতায় ভেজা,অর্ধস্বচ্ছ ও লম্বা দাগের সৃষ্টি হয়।অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাগ পাতার শীর্ষে শুরু হয়।
৩) দাগ ক্রমশ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বড় হতে থাকে এবং ঢেউ খেলানো প্রান্ত বিশিষ্ট হয়।
৪) দাগগুলো ক্রমশ হলুদ বা হলদে সাদা ধুসর বর্ণের হয়।
৫) সকালে দুধের মতো সাদা বা অর্ধস্বচ্ছ রস আক্রান্ত স্থান থেকে ধীরে প্রবাহিত হয়।
৬) শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্যাপ্রোফাইটিক ছত্রাকের আক্রমণে ক্ষত স্থান ধুসর বর্ণের হয়।
৭) আক্রমন বেশি হলে পাতা দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং গাছটি মরে যায়।
৮) লাগানোর ১-৩ সপ্তাহের মধ্যে চারাও প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত হতে পারে।আক্রমণ বেশি হলে চারা ঢলে পড়ে।
৯) ধানের ছড়া বন্ধ্যা হয়, তাই ফলন ৬০% পর্যন্ত কম হতে পরে।
১০) ধানের শীষে কোন ফলন হয় না।
১১) আক্রান্ত গাছের অধিকাংশ ধান চিটায় পরিণত হয়।
রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ :
১) সবচেয়ে কার্যকরী হলো রোগ প্রতিরোধক্ষম প্রকরণ চাষ করা।
২) বীজই রোগ জীবাণুর প্রধান বাহন। ব্লিচিং পাউডার (১০০ mg/ml) এবং জিঙ্ক সালফেট (2%) দিয়ে বীজ শোধন করলে রোগাক্রমণ বহুলাংশে কমে যায়।
৩) কপার যৌগ, অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার ভালো সুফল আনে না,কিছুটা উপকার হয়।
৪) জমিকে অবশ্যই অগচমুক্ত রাখতে হবে।এছাড়া ধানের খড়, নিজ থেকে গজানো চারা সরাতে হবে।
৫) বীজতলায় পানি কম রাখতে হবে, অতিবৃষ্টির সময় পানি সরানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।চারা থেকে চারার দুরত্ব, লাইন থেকে লাইনের দুরত্ব,সার প্রয়োগ বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে।
৬) বীজ বুনার আগে জমিকে ভালোভাবে শুখাতে হবে,পরিত্যক্ত খড় ও আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৭) রোপণের সময় চারা গাছের পাতা ছাঁটাই করা যাবে না।
৮) গাছ আক্রান্ত হলে হেক্টর প্রতি ২ কেজি ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে।
৯) নাইট্রোজেন সার বেশি ব্যবহার করা যাবে না।
১০) ফিনাইল সারফিউরিক অ্যাসিটেড এম. ক্লোরামফেনিকল ১০-২০ লিটার পরিমাণে মিশিয়ে আক্রান্ত ক্ষেতে ছিটালে রোগ নিয়ন্ত্রণ হয়।
১১) বীজ বপনের আগে ০.১ সিরিসান দ্রবণে ৮ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে বীজবাহিত সংক্রমণ রোধ হয়।