মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে দিন দিন । দেশ দিন দিন অশান্ত হয়ে উঠছে । মানুষের পকেটে ঢাকা থাকলেও মনে শান্তি নেই । পেটে ভাত থাকলেও অন্তরে স্বস্তি নেই । দিন দিন মানুষ আতঙ্ক বাধ করছে ।
খুন খারাবি , মারামারি , রাহাজানি , গুম , অপহরণ বাড়ছে । তার ওপর রক্ষক হয়ে যারা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ । হয়েছে , তাদের কারণে এই অশান্তি আরও বেড়ে যাচ্ছে । এইসব অপরাধ কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে ।
প্রতিদিন লেখালেখি হচ্ছে , অনেকগুলো টকশোর । আয়োজন করা হচ্ছে । বিভিন্ন ধরনের আইন বানানো হচ্ছে । কিছুদিন পরপর আবার এই আইনকে কাঠোর করা হচ্ছে । কিন্তু ফলাফল শূন্য । অপরাধ বাড়ছেই ।
জ্ঞানীগুণী মানুষজনের আর্টিকেল আর টকশোগুলো দেখলে বাঝো যায় একটি বিষয়ে তারা সবাই একমত যে , অপরাধ বন্ধের জন্য শুধু আইন যথেষ্ট নয় , এর জন্য প্রয়োজন মানসিক পরিবর্তন ।
এখানে এসেই বক্তব্য শেষ হয়ে যেতে দেখা যায় । এই মানসিক পরিবর্তনটা কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে তেমন বেশি আলোচনা হতে দেখা যায় না ।
ভাবটা এমন যেন এমনি এমনিই মানসিক পরিবর্তনটা হয়ে যাবে অথবা কেউ ইচ্ছে করলেই তার মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এসে যাবে । তবুও তাতে পরিবর্তন আসছে না ।
কিন্তু কেন ? আমাদের নিবন্ধের অবতারণা সেখান থেকেই শুরু হবে । যেখানে এসে সবাই থেমে যায় । অর্থাৎ আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন কীভাবে আসতে পারে ।
সবাই একমত যে , আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন না এলে অপরাধ প্রবণতা কমবে না । মানসিক পরিবর্তনটা আমাদের মধ্যে আসবে কীভাবে ? অনেকেই মনে করেন লেখাপড়া করলে মানসিক পরিবর্তন আসে ।
কিন্তু দেখা যায় , কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেও পিস্তফা আর রাম দা নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে অনেকে । সন্ত্রাসের গডফাদার যাদেরকে বলা হয় , খোজ _ নিলে দেখা যাবে তারাও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ।
পাস করেছেন । রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন হয়ে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের সম্পদ চুরি করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন , তাদের মধ্যে অনেকেই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই একটি ডিগ্রি গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন ।
অফিসের আরামদায়ক চেয়ারে বসে ঘুষ – দুর্নীতির মাধ্যমে যারা দেশের বারোটা বাজাচ্ছে তাদের সবাই শিক্ষিত । তাহলে বুঝাই যাচ্ছে – যে মানসিক পরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে , সেই মানসিক পরিবর্তনটা লেখাপড়া করার পরও আসছে না ।
তাহলে কি টাকা থাকলে অপরাধ কমবে ? বা টাকা দিয়ে মানসিক পরিবর্তন কেনা যায় ? টাকার জন্যই অধিকাংশ অপরাধ করা হয় তা সত্য । কিন্তু খোজ নিলে দেখা যাবে গরিবের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কম । ধনীরাই অপরাধ করে বেশি ।
লাখপতি অপরাধ করে কোটিপতি হয় । কিন্তু গরিব সেই গরিবই থাকে । তার মানে টাকা দিয়ে মানসিক পরিবর্তন আসে না । বরং এই টাকা অধিকাংশ |
সময় মানুষকে আরো বেশি অপরাধের জগতে ঠেলে দেয় । অধিকাংশ সময় টাকার কারণে মানসিক পরিবর্তনটা অবনতির দিকেই হয়ে থাকে । তাইতো প্রবাদ হয়েছে – অর্থই অনর্থের মূল । আইন দিয়ে যে অপরাধ দমন করা যাচ্ছে না , তা প্রতিদিন ,
কয়েকবারই প্রমাণিত হচ্ছে । যারা আইন প্রয়োগ করে তারাও অনেকে অপরাধীদের সাথে হাত মেলায় । অপরাধীরা । আইন প্রয়োগকারীদের সহযোগিতা পেয়েই অপরাধ করে অধিকাংশ সময় । অপরাধ বন্ধে যে মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে ,
সেটা এই জায়গায় এসে আরো প্রকটভাবেই ধরা পড়ে । কিন্তু মানসিক পরিবর্তন আসবে কীভাবে ? কারো কাজ দিয়েই তাকে চেনা যায় যে সে ভালো মানুষ । নাকি খারাপ মানুষ । ভালো মানসিকতাসম্পন্ন মানুষেরাই | ভালো কাজ করে ।
আর ভালো কাজ করলেই কেউ ভালো মানুষ হতে পারে । এই ভালোমানুষ তৈরি করার মতো | কোনো মেশিন এখনও তৈরি হয়নি । তাহলে ভালোমানুষ তৈরি হয় কোথায় ? কীভাবে ? উপরের আলোচনা থেকে বাঝো গেছে যে , কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও অনেকে ভালোমানুষ
হতে পারছে না । টাকা দিয়েও ভালোমানুষ হতে পারছে না । আইন দিয়েও ভালোমানুষ তৈরি করা যাচ্ছে না ? তাহলে উপায় ?
হ্যা , উপায় আছে । আমরা জানি শিশুকাল থেকেই মানুষ তার আশপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে । একটা শিশু যেরকম পরিবেশে বড় হয় ,
সেরকম মানুষ হিসেবেই গড়ে ওঠে সে । হিন্দুর ঘরে জন্ম নিলে সে হিন্দু হয় , মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলে সে মুসলমান হয় । অপরাধীদের সাথে থাকলে সে অপরাধী হয় , আর ভালোমানুষদের সাথে থাকলে সে ভালোমানুষ হিসেবেই গড়ে ওঠে ।
অর্থাৎ ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থাকলেই শুধু ভালোমানুষ হওয়া যায় ,
অন্য কোনোভাবেই নয় । যে ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থেকে মানুষ ভালোমানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেই ভালোমানুষটা কে ? এখানে এসে অনেকেই ভালোমানুষের সংজ্ঞাতে । মতদ্বৈততা করতে পারেন ।
তবে আমরা যদি কিছু নির্দিষ্ট মাপকাঠির ভিত্তিতে এই ভালোমানুষটাকে খুঁজি তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া তেমন বেশি কঠিন কাজ নয় । এর জন্য অবশ্যই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎসাহস আমাদের থাকতে হবে ।
এবং নির্বাচনি প্রচারণার মতো সত্য মিথ্যা যাচাই না করে অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র বলার মানসিকতা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে । অসৎ মানুষের অসদাচরণের কারণে আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়
থেকে শুরু করে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যেসব | অশান্তির মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিদিন , তার ওপর ভিত্তি করেই আমরা সৎ আর অসতের পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করতে | পারি । যেমন যারা ঘুষ খায় না তারা সং , আর যারা ঘুষ খায় তারা অসৎ ।
যারা দুর্নীতি করে না তারা সৎ , আর যারা দুর্নীতি করে তারা অসৎ । যারা দেশের সম্পদ চুরি করে না তারা সৎ , আর যারা দেশের সম্পদ চুরি করে তারা অসৎ । যারা মিথ্যা কথা বলে না তারা সৎ , আর যারা মিথ্যা কথা বলে তারা অসৎ ।
যারা দেশকে ভালোবাসার প্রমাণ রাখতে পারে তারা , সৎ , আর যারা দেশকে ভালোবাসে না তার অসৎ । যাদের কথা আর কাজে মিল থাকে তারা সৎ ,
আর যাদের কথায় আর কাজে মিল থাকে না তারা অসৎ । যারা ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতায় থাকতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয় না । তারা সৎ , আর যারা ক্ষমতায় থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে । সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয় তারা অসৎ । যারা ধর্মের বিধান মতে জীবন যাপন করে তারা সৎ ,
আর যারা ধর্মের বিধান মানে না তারা অসৎ । উপরোক্ত নীতিতে ভালোমানুষ কারা তা সহজেই শনাক্ত করা যায় । গ্রামের সব মানুষ জানে যে ,
তাদের গ্রামে কে ভালো মানুষ আর কে খারাপ মানুষ । তাদেরকে খুজে বের করা । কঠিন কাজ নয় । খুঁজলে পাওয়া যায় । যেসব মানুষ সুযোগ পেয়েও দুনীতি করে না , অপরাধ করার সুযোগ পেয়েও যারা । অপরাধ থেকে বেঁচে থাকে ,
নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে , তারা তাদের মন – মানসিকতাকে পবিত্র করেছেন । যে কারণে তাদের মনে অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মতো শক্তি সঞ্চিত হয়েছে । অর্থাৎ আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানসিক পরিবর্তন তাদের মধ্যে এসেছে ।
এসব পবিত্র মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ২ সান্নিধ্যে , তাদের পরিবেশে যারা থাকবে , তাদের মধ্যেও | অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মতো মানসিকশক্তি অর্জিত হবে । দুর্নীতি থেকে বাচার মানসিকতা তৈরি হবে । লোহা | যদি চুম্বকের সাথে লেগে থাকে
, তাহলে লোহার মধ্যেও | কিছুটা চুম্বকশক্তি চলে আসে । পানির মধ্যে নামলে ভিজতে হয় । রোদের মধ্যে দাঁড়ালে গরম লাগে , এটাই দুনিয়ার রীতি । ভালো মানুষের সাথে থাকলে ভালো মানুষ হওয়া যায় , আর খারাপ মানুষের সাথে থাকলে মানুষ খারাপ হয়ে যায় ,
এটাই দুনিয়ার নিয়ম । কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্ণবাস , অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ ।
এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পবিত্র কুরআন । মাজিদে । আল্লাহ তা ‘ আলা বলেন , হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকে । অন্য তওবার আয়াত ১১৯ ।
অন্য আয়াতে আছে , তিনিই সেই যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে , তাদেরই মধ্যে থেকে , একজন রাসুল দাড় করিয়েছেন , তিনি তাদের কাছে পাঠ করছেন তার নির্দেশাবলি , আর তিনি তাদের পবিত্র করেছেন ,
তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছেন ধর্মগ্রন্থ ও জ্ঞানবিজ্ঞান , যদিও এর আগে তারা তো ছিল স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে । সুরা জুমুআর আয়াত ২ । এ থেকে বুঝা যায় , একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে |
ওঠার জন্য শুধু শিক্ষা কখনই যথেষ্ট নয় । তার জন্য প্রয়োজন তাযকিয়ায়ে নফস বা মানসিক পবিত্রতা । নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার পাশাপাশি নীতি নৈতিকতার শিক্ষা এবং চারিত্রিক দীক্ষা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয় ।
যা আজকাল অনেকটাই অবহেলিত । প্রবাদ আছে , যে জাতি অনীর মর্যাদা দেয় না তাদের মধ্যে জ্ঞানী জন্ম নেয় না । আমাদের অবস্থাও হয়েছে সেরকম ।
ভালোমানুষদেরকে হয়রানি করা আর অপরাধীদেরকে প্রশ্রয় দেওয়া আজকাল আমাদের দেশে ডাল ভাত হয়ে গেছে । দেশপ্রেমিকদেরকে হয়রানি করা আর দেশদ্রোহীদেরকে ।
তোষামোদ করা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে । এই অবস্থা থেকে যদি বেরিয়ে আসা যায় , তবেই দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে , অন্যথায় নয় ।