সাইবার ক্রাইম বর্তমান সময়ের এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে অনেকেই ইন্টারনেটে এক সেকেন্ড সময়কেও নিরাপদ বলে মনে করতে পারছে না। হ্যাঁ তা করার যথেষ্ট কারণও রয়েছ। ইন্টারনেটে হচ্ছে না এমন কোনো কাজ খুঁজে পেতে হিমশিম খাওয়া লাগবে। পুরো বিশ্বকে জালের মধ্যে আটকে রেখে রাজত্ব করে চলেছে ইন্টারনেট। আর তাই ইন্টারনেট নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে আমার আপনার মতো সাধারণ অনেক ব্যবহারকারী।
দিনকে দিন ইন্টারনেটের ব্যবহারকারী যত বাড়ছে ইন্টারনেটে অপরাধের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। আর এইসব অপরাধের শিকার বেশি হচ্ছে ইন্টারনেটের সাধারণ ব্যবহারকারীরা। অপরাধকে আটকাতেও তৎপর হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তার সদস্যরা। তবুও থামছে না দুষ্কৃতকারীদের অপরাধ প্রবণতা। আর তাই ইন্টারনেট-এ নিরাপদ থাকতে নিজ সতর্কতার বিকল্প নেই। আজকে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে ও কি কি উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকা সম্ভব। তো চলুন শুরু করা যাক।
শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করা
ইন্টারনেট নিরাপত্তার কথা মাথায় এলেই যে কথাটা সবার আগে মনে পরে তা হলো “পাসওয়ার্ড” (Password)। প্রতিদিন ইন্টারনেটে আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে হয় যার জন্য ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড প্রয়োজন হয় সবসময়। এজন্য আমরা সহজে মনে থাকে এমন পাসওয়ার্ড-ই সাধারণত ব্যবহার করতে পছন্দ করি। কিন্তু এমনটা করেছেন তো হ্যাকারের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন যার কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই এবং কেউ সহজে গেস করতে পারবে না।
ভিন্ন ভিন্ন অ্যাকাউন্ট বা আইডির জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। এতে আপনার যদি কোনো অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয় তবে সেই ইউজার ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অন্য অ্যাকাউন্ট এক্সেস করতে পারবে না হ্যাকার।
ইমেইল ব্যবহারে সতর্কতা
ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত যেকোনো প্রয়োজনেই আমাদের প্রতিনিয়ত ইমেইল ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এই ইমেইল থেকেই আপনার সব তথ্য চুরি করে নিতে পারে হ্যাকাররা। এজন্য ইমেইলে লোভনীয় কোনো মেসেজ দেখলে সেটিতে প্ররোচিত হবেন না। সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন।
ডাউনলোড ও ব্রাউজিংয়ের সময় সতর্কতা অবলম্বন
বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা ফোনের সব তথ্য চলে যেতে পারে হ্যাকারদের কবলে শুধুমাত্র অসাবধানতাবশত ফাইল ডাউনলোড ও ভুল ব্রাউজিংয়ের কারণে। এজন্য সব সময় পরিচিত ও বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট থেকে ফাইল ডাউনলোড করুন। এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সময় লোভনীয় লিঙ্কে বা সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। HTTPS ওয়েব অ্যাড্রেস যুক্ত সাইট ব্যতীত অন্য ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে নিরাপদ থাকুন
বর্তমান সময়ে একজন মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করে। যার ফলস্বরূপ সামাজিক মাধ্যম সাইট গুলোতে অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই সাইটগুলোতে অনেকেই ফেক আইডি ও ফেক পেজ তৈরি করে মানুষের সাথে প্রতারণা করে অনেকের ব্যক্তিগত তথ্য ও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে লোভনীয় ব্যানার ও বিভিন্ন সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন এবং অপরিচিত মানুষদের সাথে নিজের তথ্য শেয়ার থেকে বিরত থাকুন।
অনলাইন শপিং সাইট
সব ধরনের কেনাকাটার জন্য এখন অনলাইন শপিং ওয়েবসাইট গুলোতেই সবাই ভিজিট করে। কিন্তু এখান থেকেও হতে পারে আপনার তথ্য ও অর্থ চুরি। ভুয়া সাইট থেকে শপিং করলে তারা আপনার ক্রেডিট কার্ডের তথ্য সহ বড় ধরনের অর্থ চুরি করে নিতে পারে। বর্তমানে হাজারো অনলাইন ই-কমার্স সাইট রয়েছে। সেখান থেকে পরিচিত ও বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট থেকেই কেনাকাটা করুন। কেনাকাটার আগে গুগল থেকে সেসব সাইটের রিভিউ গুলো দেখে নিতে পারেন।
ব্যক্তিগত তথ্য ছড়ানো থেকে সাবধান
ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য নানান প্রয়োজনে আমাদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট বা আইডি তৈরি করতে হয় বিভিন্ন সাইটে। সেই আইডি গুলো তৈরির সময় বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান করতে হয় সংশ্লিষ্ট সাইটে। যেমনঃ মোবাইল নম্বর, অ্যাড্রেস, ইমেইল ইত্যাদি। এই সব তথ্য যদি কোনো দুষ্কৃতকারীর হাতে পরে তবে সে সেই তথ্যগুলোকে খারাপ কাজে ব্যবহার করতে পারে যা আপনার জন্য বিপদজনক।
আমরা অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে এখন নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করতে পছন্দবোধ করি। অনেকে এটাও ভেবে বসে যে তার অ্যাকাউন্ট কেউ কেনইবা হ্যাক করবে। কিন্তু অনলাইনে যারা অন্যের ক্ষতি করার জন্য বসে আছে তাদের কাছে এই তথ্যই অনেক বেশি কিছু। তারা এই তথ্যগুলোর দ্বারা আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতেও পিছ পা হবে না। এজন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো তথ্যই এসব জায়গায় দেয়ার আগে কয়েকবার ভেবে নিন ।
ইন্টারনেট ব্রাউজার ব্যাবহারে সতর্কতা
আমরা সবাই ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় বিভিন্ন ধরনের ব্রাউজার (Browser) ব্যবহার করি। এ দিকেও আমাদের নজর রাখতে হবে। কারণ এখন অনেক ব্রাউজার বের হয়েছে যেগুলো ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নেয়। সবচেয়ে ভালো ও জনপ্রিয় ব্রাউজার গুলোর মধ্যে গুগল ক্রোম (Google Chrome), মজিলা ফায়ারফক্স (Mozilla Firefox), অ্যাপল সাফারি (Apple Safari), মাইক্রোসফট এজ (Microsoft Edge), অপেরা (Opera) ইত্যাদি ব্যবহার করা সেফ। ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা ফোন ছাড়া অন্য কারোর ডিভাইসে ব্রাউজার ব্যবহারের সময় Incognito Mode ব্যবহার করুন যাতে আপনার কোনো তথ্য সেই ব্রাউজারে সংরক্ষিত না থাকে।
পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন
আজকাল যেখানে সেখানে আমরা ওয়াইফাই (Wifi) কানেক্ট করে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শুরু করি। কিন্তু সেই একই ওয়াইফাই যদি কোনো হ্যাকার ব্যবহার করতে থাকে এবং সে যদি চাই তাহলে খুব সহজেই আপনার ফোন ও ল্যাপটপের সকল তথ্য খুব সহজেই হাতিয়ে নিতে পারে। কেননা পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের সিকিউরিটি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে থাকে। এজন্য পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন।
অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন
একটি ভালো মানের অ্যান্টিভাইরাস (Antivirus) আপনার ইন্টারনেট নিরাপত্তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। আপনি কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোন যেটাই ব্যবহার করেন না কেন একটি অ্যান্টিভাইরাস থাকলে আপনার ডিভাইসটি ক্ষতিকর ভাইরাস ও ম্যালওয়্যারের কবল থেকে রক্ষা পাবে। আপনি যদি ভুলবশত কোনো ফিশিং সাইটে প্রবেশ করতে যান তাহলে অ্যান্টিভাইরাস সেই অ্যাড্রেসটিকে ব্লক করে দিবে। এজন্য অবশ্যই আপনার একটি ভালো মানের ও প্রতিনিয়ত আপডেটেড এমন অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করতে হবে।
বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট টু-স্টেপ ভেরিফিকেশন চালু করা
অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট যেমনঃ ফেসবুক, টুইটার, জিমেইল, ইয়াহু, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি অ্যাকাউন্টের টু-স্টেপ ভেরিফিকেশন (Two Step Verification) নিরাপত্তা পদ্ধতি চালু করুন। এই নিরাপত্তা পদ্ধতিটি চালু করলে কেউ যদি আপানার পাসওয়ার্ড জেনেও যায় তারপরও অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবে না। কারণ এই পদ্ধতি চালু করার সময় আপনার মোবাইল নাম্বার সেখানে দিতে হবে। আপনি যে নাম্বার দিবেন, প্রতিবার অ্যাকাউন্ট-এ লগইন করার সময় সেই নাম্বার এ একটা পিন কোড আসবে। সেই পিন কোড না দেয়া পর্যন্ত আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করা সম্ভব হবে না।
ইন্টারনেট নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এজন্য আমাদের সবার দায়িত্ব ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার করা এবং এই বিষয়টি সম্পর্কে অন্যান্য মানুষদের জানানো। এতক্ষণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।