আজ সকাল থেকে আম্মুর মেজাজ কেমন তা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছি যখনই দেখবো আম্মুর মেজাজ খুব ভালো তখনই আম্মুর কাছে আবদারটা করে বসবো।
আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো দুপুর নাগাত। আম্মু অনেক খুশি কারণ কাল খালা আসবেন আমাদের বাসায় বেড়াতে। ফোন করে বার্তাটা আম্মুকে দেওয়ার সাথে সাথেই আম্মুর মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেল। আমিও দেখলাম এটাই সঠিক সময় কাজে লেগে পড়ার।
আম্মু খবরটা পাওয়ার সাথে সাথেই কালকের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এই সেই নাস্তা খুশি মনে বানাচ্ছেন। আমি ধীর পায়ে রান্না ঘরে ঢুকলাম। আম্মুর পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে হবে কিনা জানতে চাইলাম। আম্মু অনেক খুশি তাই খুশির ঠেলায় এই অপ্রত্যাশিত স্বর্ণ সুযোগটা নিজের অজান্তেই প্রত্যাখ্যান করলেন।
আমিও মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলাম কাজ করা থেকে বেঁচে যাওয়ায়। সাধারণত এমন হয় না কখনো কখনো আম্মু কান মলা দিয়ে হলেও কাজ করিয়ে ছাড়েন।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচু স্বরে মিনমিন করে বলতে শুরু করলাম, ‘আম্মু এই সপ্তাহে আমাদের ক্লাস থেকে ট্যুর মানে শিক্ষাসফরে যাওয়া হচ্ছে। শুধু মেয়েরা যাবে। স্যার-ম্যাডাম গাইড করে নিয়ে যাবেন। দিনে দিনেই চলে আসা হবে।’
‘হুমম। তা কবে এই বেড়াতে যেতে হবে?’
‘সামনের সপ্তাহে এই শিক্ষা সফরে যাওয়া হবে।’
‘আমাকে বলার কি আছে তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো। তোমার বাবা পারমিশন দিলে যেখানে খুশি যাও। আমার আর কি বলার!’
‘বাবা বললো তোমাকে জিজ্ঞেস করতে।’
‘কেন? সন্তান কি আমার একার? সে এসব আবদারের ঢাল নিতে পারে না। সব সময় আমি কেন বলবো কি করতে হবে না হবে?’
আমি বুঝে গেলাম উপকূলে ঝড়ের সংকেত না আসলেও আমার মায়ের মেজাজে ঝড়ের সংকেত এসে গেছে। তাই চুপচাপ কেটে পরলাম। আবার বাবার কাছে যাচ্ছি এটা বলতে যে মা বলেছেন উনার পারমিশন নিতে। আমি এটাও জানি যে বাবা আবারো আমাকে বলবেন তোমার মাকে জিজ্ঞেস করো এসব।
আমি জানি না কিছু। উত্তর জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করতে গেলাম এবং প্রত্যাশিত উত্তর কুড়িয়ে আবারো রান্নাঘরে এলাম শেষ বারের মতো চেষ্টা করতে। এসে দেখলাম আমার পিঠাপিঠি বড় ভাইটা রান্নাঘরের টেবিলের উপর লুঙ্গি পরা অবস্থায় পা দুলিয়ে বসে আছে।
আমি ওর চেহারা দেখেই তার মতলব বুঝে গেলেও আমার মমতাময়ী মা বুঝলেন না। তারা দুজন সানন্দে গল্প করছেন। আমিও বিড়ালের মতো একটা চেয়ারে বসে পরলাম তাদের কথোপকথন শেষের অপেক্ষায়। আমার সুযোগসন্ধানী, কুটনা বুদ্ধিসম্পন্ন ভাইটা অনবরত আমার বাপের গুষ্টির বদনাম করে যাচ্ছে।
মা উনার ছেলে রতনের এই কথাবার্তাগুলো খুব করে উপভোগ করছেন। সেও আমার বাবার গুষ্টির সবাইকে নিয়ে লবণমরিচ মাখানো মন্তব্য করে যাচ্ছে। অপরদিকে মায়ের গুষ্টির সবাইকে নিয়ে মধুচিনি মিশানো মন্তব্যের আসর বসিয়েছে। কিছুক্ষণ আগের আমার আবদারে মায়ের তিরিক্ষি মেজাজ অনতিবিলম্বে চটপটা হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ আমার ভাই আয়েশ করে বসে বসে তার মেহনত দিল তারপর পারিশ্রমিক আদায় করে নেওয়ার জন্য বললো, ‘মা দুই সপ্তাহ অন্তর আমার ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে কক্সবাজার ট্রিপে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব জং ধরা মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আরকি। ট্রিপে গিয়ে মন হালকা করে এসে দম লাগিয়ে পড়বো। তখন ব্রেইন ফ্রেশ থাকবে পড়ায়ও মনোযোগ বাড়বে।’
মা স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, ‘আচ্ছা।’
আমার ভাই মনে মনে বাদশার ছাগলমার্কা গানে ছাগলের মতো নেচে উঠলো। এই বুঝি মা মেনে নিলেন যেহেতু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি। সে একপ্রকার হেলেদুলেই বললো, ‘ট্রিপের খরচ বাবা দিবেন বলেছেন শুধু তোমার পারমিশনটা লাগবে।’
মা এবার অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের আইসবার্গের থেকেও ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, ‘বাহ তোমার বাবা খরচ দিবে বলেই দিয়েছে যখন আমার কাছে পারমিশন নেওয়ার জন্য পাঠানোর দরকার কি ছিল? সন্তান তো তার একার এজন্যই নিজেই ছেলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে একা। আমাকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করে নি।’
আমার ভাই হইহই করে বলে উঠলো, ‘আরেহ নাহ আম্মু না। বাবা শুধু বলেছে টাকার প্রয়োজন হলে বলতে আর যাওয়ার পারমিশনটা তোমার কাছ থেকেই নিতে। বাবা যাওয়ার পারমিশন নিয়ে কিছু বলেন নি।’
এদিকে তাদের কথোপকথনে আমি স্তব্ধ, নিস্তব্ধ, অবাক, হতবাক। মা’তো সেই ঘুরান্টি মারছেন। কিছুক্ষণ আগে সন্তান উনার একার বলে বিগড়ে গিয়েছিলেন এখন সন্তান বাবার একার কেন এজন্য চটে গেছেন।
কি লজিক ভাই! সে যাই হোক এসব নিয়ে কোনো কথা না বলে আমি আগের মতোই নীরব দর্শক হয়ে বসে রইলাম। এখন ঝামেলার শুরুর পথে কথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো মেয়ে আমি না।
আমার ভাইটা এখন কোনো উপায় না পেয়ে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। ওর অনুরোধ আম্মু ঠেকাতে না পেরে পারমিশন দিয়ে দিলেন। তবে একটা তরতাজা শর্ত সহিতে পারমিশন দিলেন। শর্তটা হলো সন্ধ্যা ৭টার আগেই বাসায় ফিরার শর্ত।
এটা শুনেই আমার ভাই স্ট্যাচু অফ লিবারটির বদলে স্ট্যাচু অফ সাবজেগেসন হয়ে গেল। ভেঙে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়টা নিয়ে রান্নাঘর ত্যাগ করতে করতে বিড়বিড় করে বলছিলো, ‘সিলেট থেকে চট্টগ্রাম! সন্ধ্যায় ফিরে আসতে হবে! বুলেট ট্রেন কি নিজেই বানিয়ে ফেলবো? কি করবো কি করবো!!!’
ওর এই জরাজীর্ণ চেহারা দেখে কষ্ট পাওয়া উচিত আমার কিন্তু পাচ্ছি না। আনন্দ হচ্ছে এই ভেবে যে একটু পর আমিও যখন প্রত্যাখ্যাত হবো তখন নিজেকে একা দ্বীপের বাসিন্দা মনে হবে না কারণ সেই দ্বীপে আমার বাঁদর ভাইটাও ঝুলবে শত ব্যথা বুকে চেপে।
সে লুঙ্গিতে গিট্টু দিতে দিতে বের হয়ে গেল রান্নাঘর থেকে কিন্তু সেকেন্ড গড়াতে না গড়াতে বিদ্যুৎ বেগে আবারো ফিরে এসে রান্না ঘরে ঢুকলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম মাথাটা ঝনঝন করছে। তার মানে কি দাঁড়ায় দায়া থুক্কু দয়ারে কই পাবো।
তাই নিজেই অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করলাম আমার ভাইটা ফিরে এসে আমার মাথায় গাট্টা মেরে গেছে। তার হৃদয়ের রাগ দুঃখ সব আমার মাথাতেই ঝেড়ে চলে গেছে। আমি ফিরতি মার দিতে উপক্রম হলাম। প্লাজো গিট্টু দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম প্রতিশোধ নিতে। তার পিছন নিবো তখন ভাবলাম শেষ চেষ্টা করে দেখি জানি কাজ হবে না তবুও আফসোস না রাখার জন্য করি।
তাই আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আম্মু বাবা আবারো বলেছে তুমি যেতে বললে তিনিও যেতে দিবেন আমায়।’
মা অগ্নি দৃষ্টির মুখশ্রীতে স্নিগ্ধতার এক অদ্ভুত মিলন ঘটিয়ে বললেন, ‘ বিয়ের পর জামাইকে নিয়ে যেও মা। এখন এরকম টইটই করতে হবে না। জামাইকে নিয়েই টইটই-পইপই যা ইচ্ছে করিও তখন আর আটকাবো না।’
আমিও এখন মায়ের মতো অদ্ভুত মুখভঙ্গি করলাম। চোখে দুঃখের অশ্রু আর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঠিক যেন সিনেমার জোকারের মতো। আমার এই মিশ্রিত ভঙ্গি মায়ের উদ্দেশ্য প্রেরণ করে দৌড় দিলাম ভাইটার মাথায় গাট্টা মেরে নিজেকে হালকা করতে।
(সমাপ্ত)
😯😯😯
Tour
Sad
Ok
👍🏻
Sundor
Nice
nice
nice
Nice