নিশুর চোখে স্বাধীন বাংলা

১২ নভেম্বর, ১৯৭১
দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে।দেশের সকল শ্রেণির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারলেও কিছু হতভাগ্য মানুষ পারলেন না। এই যেমন সুনীল মন্ডল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন তিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে এক সড়ক দূর্ঘটনার তিনি তার পা দুটো হারান। এর পর থেকে সঙ্গী এই হুইলচেয়ার। দেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থাকা সত্বেও তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাই বলে কিন্তু তার চেষ্টা থেমে থাকে নি।

অস্র হিসেবে তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই কলমের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এখনো এই কলমের যুদ্ধ শেষ হয়নি। সুনীল বাবু তার এই মস্ত লাইব্রেরিতে বসে লিখেই যান। লিখতে লিখতে হাত অসার হয়ে আসে,তবু লেখা শেষ করেননা তিনি।সুনীল বাবুর লেখাগুলো ছদ্মনামে বেতার কেন্দ্রেও প্রকাশিত হয়।যা শুনে অনুপ্রাণিত হয় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধারা। মাঝে মাঝে লিখতে গিয়ে সুনীল বাবুর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
এই মস্ত বাড়িতে সুনীল বাবু একাই থাকেন। বিয়ে করেননি।

তার বয়স এখন ৫৬ বছর। বাড়িতে সাহায্য করার জন্য নিশু নামের একটা ১৫ বছরের ছেলে আছে।খুব চটপটে আর প্রানবন্ত স্বভাবের। কিন্তু যুদ্ধের পর থেকে ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে।জানালার কাচ দিয়ে দূরপানে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে। কখনো এই দূরন্ত কিশোরের চোখে খেলে ভয়,কখনো তৃপ্তি,কখনো উৎকণ্ঠা,কখনো রহস্য।সুনীল বাবু বুঝতে পারে মুক্তিযুদ্ধ নিশুর মনে খুব বড় প্রভাব ফেলেছে।খুব ভালো বাঁশি বাজায় নিশু।মাঝে মাঝে সুনীল বাবু যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শুনতে পায় নিশু বাঁশি বাজাচ্ছে।অদ্ভুত মায়া আছে ওর বাশির সুরে।

যা পৃথিবীর সব সুর হার মানায়।নিশুর বাবা মা কেউ নেই।ছোট বেলায় কলেরায় মারা গেছে সবাই।তারপর থেকে নিশু এই বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের সব খবরাখবর নিশু সুনীল বাবুকে এসে বলেন।এই যেমন গ্রামের কোন কোন ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে,কাদের বাড়িতে রাজাকারেরা আগুন দিয়েছে,কাকে গুলি করেছে,কারা কারা রাজাকারের দলে নাম লিখিয়েছে এইসব।তবে একটা কথা নিশু এতদিন গোপন রাখলেও সেদিন প্রকাশ করে সুনীল বাবুর কাছে।নিশু ৫ মাস যাবত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে আসছে।কখনো খাবার সরবরাহ করে ,কখনো খবর সংগ্রহ করে।এর মাঝে একটা বড় কাজ নিশু করেছে।

গত ৮ দিন আগে গ্রামের রাজাকারের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে এসেছে। সেদিন নিশু সুনীল বাবুকে বলে
-জানেন কাকাবাবু কী হইসে?
-কী হয়েছে নিশু?
-গ্রাম থিক্কা ২ মাইল দূরে নদীর ধারে মিলিটারিরা একটা ঘাটি গড়ছিলো।কাইল রাইত্তে মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মাইরা উড়াইয়া দিসে।
কথাগুলো বলার সময় যেন নিশুর চোখ দুটো বড় হয়ে যায়।
-তুই ওখানে ছিলি নিশু?
নিশু কিছু বলে না।

-নিশু,দেশের যা অবস্থা, আজ নয়তো কাল হয়তো মিলিটারিরা এই বাড়িতে আক্রমণ করতে পারে।আর আমি তো আর পালাতে পারবো না।এই দেশটাকে তুই স্বাধীন করবি তো নিশু?
-কাকাবাবু আপনের কিচ্ছু হইবো না।
-মিলিটারিদের সাথে কী আর আমি পেরে উঠবো রে নিশু!
-আপনের গায়ে একটা ছোয়া যদি ওরা দেয় কাকাবাবু…
-কী করবি নিশু?
– জানে মাইরা হালামু।
সুনীল বাবু তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে নিশুর দিকে।নিশুর চোখে এখন ক্রোধ খেলা করছে।সুনীল বাবু ভাবেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নিশুকে নিয়ে একটি বই লিখবেন তিনি।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।এমন দিনে বৃষ্টির কোন মানেই হয়না।নিশুটা সেই যে বেড়িয়েছি এখনো ফেরেনি। কে জানে বেচারা হয়তো বৃষ্টিতে ভিজছে।এমন দিনে খুব খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করে। নিশুটা এলে বলতে হবে বড় কড়াইয়ে করে যেন খিচুড়ি রান্না করে।তারা দুজন খাবে আর বাকিটা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠাবে।
সুনীল বাবুর কলমের কালিটা ঝাপসা হয়ে আসছে।এইতো কাল এই নতুন কলমটা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলেন।আজ শেষ হবে কেন!সুনীল বাবু হুইলচেয়ার টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বইয়ের তাকের দিকে এগিয়ে যান।নতুন কলম আনতে হবে।নিশুকে বলতে হবে এই কলম যেন আর না কিনে আনে। এর আগে যে কলমটা দিয়ে লেখা হয়েছিলো সেটা খুব ভালো ছিলো।
হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে সুনীল বাবু হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে দরজায় দেখেন। কিছু বুঝতে পারার আগেই ৩ জন মিলিটারি আর দুজন রাজাকার ঢুকে যায় তার লাইব্রেরিতে। এদের চিনতে পারছে সুনীল বাবু। গ্রামের চেয়ারম্যান আর তার ছেলে। এরা রাজাকারের দলে নাম লিখিয়েছে। ছি!
একজন বলে ওঠে
-বাঙালীকা বাচ্চা!

-সুনীল বাবু,এইযে আপনে হুজুরগো নামে যা ইচ্ছা তাই লিখা যাইতাসেন এইডা কী ঠিক!কী হইবো এডি কইরা!আপনে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন বইলা কী আমরা ধরতে পারুম না ভাবসেন!
-আমিই ঠিক আছি।তোমরা ভুল করছো।খুব বড় ভুল।
বিদঘুটে একটা হাসি দিয়ে রাজাকার বলে ওঠে
-ভুল করতাসি!কী ভুল!
-দেশের মানুষ হয়ে দেশের সাথে বেঈমানী করছো!
-দেশ?আরে হুজুরগো দয়ামায়ার জোরেই তো আমরা বাইচ্চা আছি।আর তাগো লগে আমি কী আর বেঈমানী করতে পারি?
-এই ভুলের খেসারত তোমাদের দিতেই হবে।দেশ স্বাধীন হবে।আর স্বাধীন দেশের মানুষ তোমাদের কক্ষনো ক্ষমা করবে না।
-দেশ স্বাধীন হইলে তারপর তো!
-তোমরা মানুষ নও।মানুষ নামের কলঙ্ক!
 চেয়ারম্যান তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তারপর মিলিটারির কাছে গিয়ে বলে
-হুজুর,ইয়ে মালুমকা বাচ্চা নেহি সামঝেগা।
তারপর সুনীল বাবুর দিকে তাকিয়ে একটা কুৎসিত হাসি দিয়ে বলে
-মর তাইলে গুলি খাইয়া।

-দেশের জন্য যদি মরতে হয় তবে সেটা হবে গৌরবের মৃত্যু।তোমাদের মতো কাপুরুষ নই আমি।
রাজাকার ও তার ছেলে ইশারা করে সুনীল বাবুর দিকে। সুনীল বাবু তার দুই বাহু দুইদিকে প্রসারিত করে বলে ওঠে
“জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”
পরপর দুটো গুলি এসে সুনীল বাবুর বক্ষে বিধে যায়। হুইলচেয়ার থেকে পড়ে যান সুনীল বাবু। তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে।মিলিটারিরা বের হয়ে যায় ঘর থেকে।সুনীল বাবু নিশুর কথা ভাবতে চেষ্টা করে।কোথায় নিশু!নিশুকে শেষ দেখা হলোনা তবে!নিশুকী পারবে স্বাধীন করতে এই বাংলাকে!
পরক্ষণেই বাইরে পরপর ৫ টা গুলির শব্দ শুনতে পান সুনীল বাবু।সুনীল বাবুর বুঝতে বাকি রইলো না কার কাজ এটা।তীব্র যন্ত্রণা নিয়েও সস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন তিনি।তারপর মাথাটা এলিয়ে দেন মাটিতে।
নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসছে।চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে তার।হঠাৎ করে এই বদ্ধ ঘর,লাইব্রেরি, সারি সারি বই সব যেন উধাও হয়ে যায়।

একটা সবুজ মাঠ। সূর্য উদিত হচ্ছে।মাঠের প্রতিটি ঘাসের কোনে বিন্দু বিন্দু শিশির। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত রূপ উজাড় করে দিয়েছে এই ফসলের মাঠে।সুনীল বাবু তার হুইলচেয়ার নিয়ে কোনদিন ঘর থেমে বের হতে পারেননি এই বাংলাকে দেখার জন্য।আজ মৃত্যুর আগে কল্পনায় হলেও দেখতে পাচ্ছে।হঠাৎ তার মনে হলো সে হয়তো নিশুর চোখে স্বাধীন বাংলা দেখতে পাচ্ছে।সেই মায়া ভরা টলটলে চোখে সবুজ শ্যামল মাঠ।সুনীল বাবুর কানে যেন দূর থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসছে।সে শুনতে পাচ্ছে না।আওয়াজটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।হ্যা,এইতো শোনা যাচ্ছে।কী মধুর সুর!
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।।
নিস্তব্ধ হয়ে যায় সুনীল বাবুর দেহটা।শুধু মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে থাকে।‍

Related Posts

11 Comments

মন্তব্য করুন