পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী পাখি— কাক ও পেঁচা প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু!

গ্রামাঞ্চলে কাক ও পেঁচা দুটিকেই অশুভ পাখি হিসেবে গণ্য করা হয়। কাক কিংবা পেঁচা দেখলে মানুষ খারাপ কিছু হবে বলে আশঙ্কা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাক এবং পেঁচা দুটোই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী পাখি। কাক দূষিত ও নোংরা পঁচাগলা খাবার-দাবার খেয়ে পরিবেশকে পরিস্কার রাখে। তেমনি পেঁচা ইঁদুর ও ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ এবং পোকামাকড় খেয়ে ব্যাপকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

কৃষি বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পেঁচা এক বছরে যে পরিমাণ ইঁদুর খায়; সেই ইঁদুর বছরে কৃষকের এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার অর্থাৎ প্রায় দেড়লক্ষ টাকার ধানসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট করে। একটি পেঁচা বছরে দেড়লক্ষ টাকার খাদ্যশস্য রক্ষা করে। তাই পেঁচা ও কাক প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু।

গ্রামাঞ্চলে আগে দেখা যেতো, কাক সাবান চুরি করে নিজের বাসায় না নিয়ে প্রথমে কোনো খড়ের ঘরের চালে গুঁজে রাখতো। এর কারণ হলো, কাক যখন খড়ের চালে সাবান গুঁজে রাখতো, তখন সে চোখ বন্ধ করে ফেলতো। কাক মনে করে, যেহেতু সে কোনো কিছু দেখতে পারছে না; তাই কেউ কিছু বোধহয় দেখতে পারছে না।

অতিশয় চালাক কাকের এই অতি বোকামি সত্যিই খুব মজার। গ্রামাঞ্চলে একেই হয়তো বলে, অতিচালাকের অতিবোকামি। তবে ইদানীং গ্রামাঞ্চলে খড়ের কুঁড়েঘর কমে যাওয়ার ফলে কাকের এই অতিচালাকির দৃশ্য অত্যন্ত দুর্লভ হয়ে পড়েছে। শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরেও কাকের অতিচালাকি এবং অতিসাহসিকতার অনেক দৃশ্য দেখা যায়। বিশেষ করে ছোঁ মেরে মাছ বা মাংসের টুকরো নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অনেক জায়গাতেই দেখা যায়।

কাক খুব সাহসী একটি নাগরিক পাখি। গ্রামেগঞ্জের কাকের চেয়ে শহুরে কাক অনেক বেশি সাহসী। তাই দেখা যায়, শহরের ইলেকট্রিক পোলে কিংবা তারে বসে কাক তক্কে তক্কে থাকে; নাগালের মধ্যে কোনো কিছু পেলে ছোঁ মেরে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খায়। আবার কাকের মধ্যে সৌখিনতা বোধ খুবই প্রবল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের বাসায়।

কাকের বাসায় এহেন জিনিস নাই যে পাওয়া যায় না। রংচঙে জিনিসপত্রের দিকে কাকের মারাত্মক ঝোঁক। বিশেষ করে রাস্তায় ফেলে দেয়া সিগারেটের প্যাকেটের প্রতি তাদের অপরিসীম আগ্রহ! লোকজন সিগারেটের প্যাকেট ফেলে দিলে কাক অতি আগ্রহে সেই প্যাকেট অবলীলায় তার বাসায় এনে জড়ো করে। শুধু সিগারেটের প্যাকেট কেনো, কাক যেখানে রংচঙে যাকিছুই পায়, তাই তার বাসায় নিয়ে আসে।

কাকের আর একটি চমৎকার স্বভাব হচ্ছে, স্বজাতির প্রতি তাদের অপরিসীম সহমর্মিতা। কোথাও কোনো কাক আক্রান্ত হলে দলে দলে কাকেরা সেখানে ছুটে গিয়ে তাকে রক্ষা করে। আবার কোথাও কোনো কাক মারা গেলে সেখানে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে দলবেঁধে উড়তে থাকে। আর কেউ যদি কোনো কাক মেরে ফেলে, তাহলে তার আর রক্ষে নেই। তার মাথায় ঠুঁকরে আঁচড়ে জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে তারা।

একবার গ্রামের এক দুষ্টু ছেলে কাকের একটা বাচ্চা ধরেছিল। ক্রুদ্ধ কাকের দল তার জীবন প্রায় বিপন্ন করে দিয়েছিল। মাথায় ঠুঁকরে আঁচড়ে তাকে অতিষ্ঠ করেছিল। পরে বাধ্য হয়ে কাকের সেই বাচ্চা ছেড়ে দিয়ে তবেই রক্ষা! পেঁচা কিন্তু কাকের মতো মারাত্মক নয়। পেঁচা অনেক নিরীহ। তবে পেঁচা ও কাক, এই দুটোই প্রকৃতির বন্ধু! প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় কাক ও পেঁচা দুটোরই ভূমিকা অপরিসীম। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে কাক ও পেঁচা— এই জাতীয় পাখিদের প্রজনন এবং অবাধ বংশবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা সুনিশ্চিতভাবেই রক্ষা করতেই হবে।

সাইফুল হক : লেখক, সম্পাদক, গবেষক।

পরিবেশ, কাক, পেঁচা, প্রকৃতি

Related Posts

15 Comments

মন্তব্য করুন