এই বইয়ের আগে-পরে কোনো বিশেষণ পদ যোগ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার আগেই যারা বইটা পড়েছেন তারা সব বিশেষন ব্যবহার করে দিয়েছেন। তাই আমার কোনো বিশেষন ব্যবহার করা আবশ্যক নহে।
এটাকে বইয়ের রিভিউও বলবো না, এটা আমার মনের উপলব্ধি।
বইয়ের একদম প্রথম লাইনটা আপনাকে বইয়ের শেষ লাইন পর্যন্ত টেনে নিবে। খালের ধারে হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিলো। সে বজ্রপাতে মারা যায়। এই যে বজ্রপাত হওয়া এই লাইনটা লেখকের ভাষায় ছিলো এরকম,”খালের ধারে প্রকান্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিলো। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।” অদ্ভুত এক ভাষা । নতুন ভাবে বর্ণনা। তার পর শুরু হয় উপন্যাসের পথচলা।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে শশীকেই ধরা যায়। উপন্যাসের সবর্ত্র রয়েছে শশীর পদচারনা। সে একজন ডাক্তার। শহর থেকে পাশ করে এসেছে। তাই গ্রামে তার একটা বিশেষ কদর রয়েছে। আর একটা কারণ হলো তার বাবা। তার বাবা গোপাল। গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। জমি বেচা কেনার কাজ করতো। সহজ ভাষায় বলা যায় দালালি করা। বাবার এসব কাজ শশীর পছন্দ হতো না। তাই বাবার সাথে শশীর একটা বিবেদ লেগেই থাকতো।
উপন্যাসের শুরুতেই যে হারু ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে কাহিনী শুরু হয়, সেই হারু ঘোষের পরিবারের সাথে শশীর খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। হারু ঘোষের ছেলে পরান ও তার বউ, মেয়ে মতি। উপন্যাসের গভীরে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাবো যে, এদের মধ্যে মতি ও পরানের বউ কুসুম ছিলো শশীর বিশেষ ভালোবাসার এবং প্রিয় মানুষ।
এখানে আরেকটি শক্তিশালী চরিত্র হলো কুমুদ। কুমুদ শশীর বন্ধু। চরিত্রের দিক দিয়ে শশী যতটা না পরোপকারী ও মহৎ ,কুমুদ ঠিক তার বিপরীত। শশী গোছানো ও শান্ত স্বভাব আর কুমুদ হলো ভবঘুরে। কুমুদের চরিত্রে সাহসিকতার ভাব রয়েছে। আছে সহজে মানুষকে বশ করার ক্ষমতা। ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষমতা। যা শশীর চরিত্রে পাওয়া যায় না। আর এটাই কুমুদের চেয়ে শশীকে দিয়েছে পরিপূর্ণতা।
কুসুম হলো বিবাহিতা। সে তো পারে না তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে। আমদের গ্রামের সহজ সরল গ্রাম্য মেয়েরা বরাবরই পুরুষদের হাতের পুতুল। সেখানে গ্রাম্য বধু হয়ে নিজের ভালোবাসাকে অন্যের নিকট প্রকাশ করা রীতিমত অন্যায়।
শশী চেয়েছে সবাইকে খুশি করতে। তা করতে গিয়ে সে নিজেই সুখি হতে পারে নি। ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে নি। সারা জীবনের জন্য কুসুমকে চেয়েও পায় নি কুসুমকে। তাই শেষ পর্যন্ত একটা হাহাকার রয়ে যায় সমগ্র উপন্যাস জুড়ে।
বিঃদ্রঃ এই উপন্যাস পড়ার পরে অনেকেই হয়তো শশীকে নায়ক হিসেবে গন্য করিয়া বিশেষ তৃপ্তি লাভ করবে। তবে আমার কাছে কেন জানি কুমুদকেই নায়ক মনে হয়েছে। এখানে যদিও কুমুদ স্বার্থপর ও ভবঘুরে একটা চরিত্র হিসেবে ছিল। বাংলা সাহিত্যের ধারায় হয়তো কোনো স্বার্থপর চরিত্র নায়ক হতে পারে না। তাই হয়ত কুমুদ নায়ক হতে পারে নি। তবে কেনই বা নির্স্বার্থ নায়ক কে হতে হবে? নায়িকারা কেন বিরহে মরবে?