কিভাবে ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকবেন? ইন্টারনেট নিরাপত্তার খুঁটিনাটি

১২ মে ২০১৭ বিশ্বজুড়ে এক বড় ধরনের সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে তা আমরা অনেকেই জানি। সেই হামলায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫০ টি দেশের কম্পিউটার ব্যবস্থায় হানা দেয় হ্যাকাররা। হামলার ফলস্বরূপ হ্যাকাররা ব্যবহারকারীর বিশাল পরিমাণের তথ্য ও অর্থ বাজেয়াপ্ত করে। শুধু এই সাইবার হামলাটিই নয় বরং বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত ছোট বড় অনেক সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে আমার আপনার মতো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সাথে।

তাই বলে যে সিকিউরিটি ব্যবস্থা দুর্বল তা কিন্তু নয়। প্রতিনিয়ত উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। তারপরও আমাদের সামান্য অসতর্কতার জন্য অনেককেই বড় মূল্য চোকাতে হয়। তো চলুন জেনে নেয়া যাক ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকার আরো বিশেষ কিছু পদ্ধতি, এছাড়া আমরা আরো জানবো সাইবার অপরাধের শিকার হলে তৎক্ষণাৎ কি কি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

অজ্ঞাত এসএমএস ও মেইল থেকে সাবধান

প্রতিনিয়ত আমাদের ফোনে ও ইমেইলে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন ম্যাসেজ আসতে থাকে। এসব ম্যাসেজে অনেক সময় আমরা বিভিন্ন লিঙ্ক (Link) লক্ষ্য করে থাকি। এবং মাঝে মাঝে সেই লিঙ্কে প্রবেশও করি। কিন্তু আপনি হয়তোবা জানেনিনা যে সেই লিঙ্ক-এ ক্লিক করলে আপনার সব তথ্য হ্যাকারের হাতে চলে যেতে পারে যদি ম্যাসেজটি কোনো ফিশিং ম্যাসেজ হয় তবে। এজন্য অজ্ঞাত কোনো লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে একশ হাত দূরে থাকুন।

অ্যাকাউন্ট প্রাইভেসি

ইন্টারনেটে আপনি যে ধরনের অ্যাকাউন্ট-ই চালান না কেন সব অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি সেটিং শক্তিশালী করুন। কারণ প্রাইভেসি যদি দুর্বল হয় তবে আপনার তথ্য যে কেউ দেখতে পারবে। যেমন ধরুন সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি। এসব জায়গায় আপনার বন্ধুরা ছাড়া যাতে অন্য কেউ আপনার শেয়ার করা পোস্ট বা কন্টেন্ট দেখতে না পারে সে জন্য অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি সেটিংসে ‘Friend’ করে রাখুন। আর এসব অ্যাকাউন্ট গুলোর ফ্রেন্ড লিস্টে যদি সন্দেহজনক বা অজ্ঞাত কাউকে দেখেন তাহলে তাদের ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে দিন। এতে করে অজ্ঞাত কেউ আপনার তথ্যের অপব্যবহার করতে পারবে না।

অ্যাপ থেকে সাবধান

আজকাল মোবাইল অ্যাপের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে করে সঠিক অ্যাপ গুলোকে বাছাই করাই মুশকিল হয়ে পরছে। আমরা বিভিন্ন প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করি। কিন্তু যে অ্যাপ ব্যবহার করছি তা আমাদের মোবাইলের তথ্য গুলোকে কতটা নিরাপদ রাখছে সেটা আমরা অনেকেই লক্ষ্য করি না। কোনো অ্যাপ ইন্সটল করার পর সেই অ্যাপ মোবাইলের Photo, Video, File, Contact, Location, Camera ইত্যাদির অ্যাক্সেস চাই। আমরা অনেক সময় খেয়াল না করেই সেগুলোকে Allow করে দিই।

কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, যে অ্যাপের যে অ্যাক্সেস প্রয়োজন না তারপরও সেই অ্যাপ যদি সেই অ্যাক্সেস নিয়ে রাখে তাহলে সেই অ্যাপের App Info থেকে Permissions এ গিয়ে সেই অ্যাক্সেস বন্ধ করে দিন। কারণ অপ্রয়োজনীয় অ্যাক্সেস দেয়ার কারণে সেই অ্যাপ আপনার তথ্য গুলো হাতিয়ে নিতে পারে। আর অবশ্যই কোনো অ্যাপ ইন্সটল করার সময় গুগল প্লেস্টোর, অ্যাপল অ্যাপস্টোর ইত্যাদি বিশ্বস্ত জায়গা থেকেই ইন্সটল করুন।

অন্য কাউকে আপানার ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়ায় সতর্ক থাকুন

আপনার ব্যক্তিগত ফোন অথবা কম্পিউটারে আপনার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ফাইল ও ডকুমেন্ট থাকে। যেগুলো অন্য কারোর হাতে গেলে আপনার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া আজাকাল ফোনকে বিভিন্ন স্পাই অ্যাপের সাহায্যে হ্যাক করা হয়। আপনার ফোন যদি অজানা কারোর হাতে পরে ও সে যদি ফোনে স্পাই অ্যাপ (Spy App) ইন্সটল করে দেয় তাহলে আপনার ফোনের সকল নিয়ন্ত্রণ তার হাতে চলে যেতে পারে। এজন্য ফোন বা কম্পিউটার অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়ায় সতর্কতা অবলম্বন করুন।

পর্নোগ্রাফি ও ডেটিং সাইট এড়িয়ে চলুন

এসব সাইটে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাবধান থাকুন। এসব সাইটে বিভিন্ন অ্যাডাল্ট ভিডিও, ব্যানার ও লিঙ্কে ক্লিক করার ফলে হ্যাক হয়ে যেতে পারে আপনার ডিভাইস। আপনি বুজতেই পারবেন না যে কখন আপনার সকল তথ্য চলে গেছে অন্যের হাতে।

ফেসবুক নিরাপত্তা

ফেসবুক নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা করে লেখার কারণ হলো বর্তমানে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া। বর্তমানে ফেসবুকে মানুষ বেশি সময় ব্যয় করে। এজন্য এখানে অপরাধ প্রবণতাও বেশি। যারা অসৎ উদ্দেশ্যে এখানে ফেক আইডি, পেজ, গ্রুপ খুলে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে তাদের থেকে সাবধান থাকুন।

ফেসবুক হ্যাক নিয়ে আপানদের সাথে ছোট একটা গল্প শেয়ার করলাম। আশা করি এটা আপনার উপকারে আসবে।

রাশেদ খান ও মতিউর রহমান দুইজন একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দুজন একই সাথে বিজনেস পার্টনার। ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তাদের প্রায় প্রতিনিয়ত ফেসবুকে যোগাযোগ রাখতে হয়। একদিন রাশেদ সাহেবের ইমেইলে একটি ব্যবসায়িক ম্যাসেজ আসলো। ম্যাসেজটি দেখতে হুবুহু মনে হলো মতিউর রহমানের ইমেইল থেকে এসেছে। কিন্তু রাশেদ সাহেব বুজতেই পারলেন না যে ম্যাসেজটি পাঠিয়েছে একজন হ্যাকার। রাশেদ সাহেব ম্যাসেজে পাঠানো একটি লিঙ্কে ক্লিক করে ফেললেন এবং সাথে সাথে হ্যাকার পেয়ে গেল রাশেদ সাহেবের ইমেইল এর নিয়ন্ত্রণ। রাশেদ সাহেব আর একটি ভুল কাজ করেছিলেন সেটি হলো ইমেইল এর পাসওয়ার্ড ও ফেসবুকের পাসওয়ার্ড একই দিয়েছিলেন। এজন্য তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে হ্যাকারের বেশি কষ্ট করতে হয়নি। ওদিকে মতিউর রহমান জানতেন না যে তার বন্ধুর অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। হ্যাকার ফিশিং লিঙ্কসহ ফেসবুকে মতিউর রহমানকে একটি ম্যাসেজ দিলেন রাশেদ সাহেবের আইডি থেকে। মতিউর রহমান সেই ম্যাসেজ পড়ে লিঙ্কে ক্লিক করলেন এবং তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টও চলে গেল হ্যাকারের হাতে।

আশা করি বুজতে পেরেছেন একটু অসতর্কতার জন্য আপনিও হারাতে পারেন আপনার মূল্যবান ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি। শুধু ফেসবুক নয় এমনটি সব ধরনের অ্যাকাউন্ট বা আইডিতেই ঘটতে পারে। এজন্য সব সময় চোখ কান খোলা রেখে ইন্টারনেট ব্যবহার উচিত। লোভনীয় কোনো ম্যাসেজ ও অ্যাটাচমেন্ট সব সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

পাসওয়ার্ড শেয়ারিং

কি আপনিও কি এই কাজটি করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে এখনি সচেতন হয়ে যান। কারণ পাসওয়ার্ড শেয়ারিং যেমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তেমনি এটি একটি অপরাধের মধ্যেও পরে। কারণ আপনি যার সাথে আপনার অ্যাকাউন্ট পাসওয়ার্ড শেয়ার করবেন সে আপানার অজান্তেই আপনার যেকোনো তথ্য নিয়ে নিতে পারে বা আপানার অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো সাইবার ক্রাইমও করে ফেলতে পারে। সেটা জেনে হোক অথবা না জেনে। আপনি নিশ্চয় জেনে শুনে আগুনে পা ফেলবেন না। এজন্য সবসময় কারো সাথে পাসওয়ার্ড শেয়ার করার আগে ভেবে দেখুন তার থেকে আপনি কতটা নিরাপদ।

আবার অনেক সময় বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য আমাদের পাসওয়ার্ড অন্য কারোর সাথে শেয়ার করার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আপনি তার সাথে সরাসরি দেখা করে পাসওয়ার্ড দিতে পারেন। অনলাইনে কোনো পাসওয়ার্ড শেয়ার করলে তাতে ঝুঁকি বেড়ে যায়। কেননা যে অ্যাকাউন্ট দিয়ে আপনি পাসওয়ার্ড শেয়ার করবেন সেটা যদি কখনো হ্যাকের কবলে পরে তাহলে আপনি তো বুজতেই পারছেন কি হতে পারে।

এখন জানা যাক ইন্টারনেটে বিপদে পড়লে তৎক্ষণাৎ আপনার করণীয় কিঃ

আপনি যদি অনলাইনে কোনো অপরাধের শিকার হোন তাহলে যথেষ্ট প্রমাণ সহ (প্রমাণের ক্ষেত্রে আপনি যে অপরাধের শিকার হয়েছেন তার স্ক্রীনশট বা কোনো লিঙ্ক বা কোনো অজানা ম্যাসেজ ইত্যাদি) নিকটস্থ থানায় মামলা করুন।

আপনি গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘Hello CT’ অ্যাপের সাহায্যেও অভিযোগ করতে পারেন। অথবা ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করতে চাইলে [email protected] এই ইমেইলে প্রমাণ সহ অভিযোগ করতে পারেন।

আপনি কোনো সাইবার অপরাধের শিকার হলে তৎক্ষণাৎ ০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮ এই নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন। এই হেল্পলাইন নাম্বারটি ২৪ ঘণ্টা সপ্তাহে ৭ দিনই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমানে ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকাটা অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। এখানে সামান্য একটু অসতর্কতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে আপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অথবা আপনাকে গুণতে হতে পারে বড় অংকের টাকা। আশা করি আপনি এই আর্টিকেল দুটি থেকে (প্রথম পর্ব—দ্বিতীয় পর্ব) ইন্টারনেট নিরাপত্তার বিষয়ে একটু হলেও উপকৃত হয়েছেন। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে আপনার বন্ধুদের শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Related Posts

24 Comments

মন্তব্য করুন