ছোটবেলায় আপনি কী শিক্ষকের হাতে মার খেয়েছিলেন? সেই অভিজ্ঞতা একটু বর্ণনা করবেন?

আমরা যারা ৯০ দশকে জন্মেছি, আমাদের সকলেরই ছোটোবেলা অসংখ্য মজার মজার স্মৃতিতে ভরপুর। আমাদের শৈশব ছিলো রংধনুর মতো রঙিন। কখনো রঙিন, আবার কখনো সাদা-কালো। ছোটবেলায় শিক্ষকের হাতে মার খাওয়া ছিলো সেই সাদা-কালো ঘটনাগুলোর মতোই। যা আমাদের স্মৃতিতে অমলিন। যে স্মৃতি কখনো ভুলা যায় না। কোনো শিক্ষার্থীকে মারতে গেলে এখনো আমার নিজের মার খাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। যদিও এখন স্কুল-কলেজে শারীরিক ও মানসিক সকল ধরণের শাস্তি নিষিদ্ধ, তবুও মাঝে মাঝে হালকা- পাতলা ব্যবহার করি। 

৯০ দশকে যারা জন্ম গ্রহণ করেছে তাদের মাঝে ছোটোবেলায় শিক্ষকের হাতে মার খায় নাই এমন বান্দা খুব কমই পাওয়া যাবে। কম হোক আর বেশি হোক মার খাওয়ার সেই তেতো স্মৃতি সবার জীবনেই আছে। আমার জীবনেও অল্প-বিস্তর আছে। ছোটোবেলায় ও বড়বেলায় দুবেলাতেই শিক্ষকের হাতে মার খেয়েছি। তবে মার খাওয়ার পরেও ফিক ফিক করে হেসেছি। কারণ না হাসলে সবাই ভাবতো,” আমি বেশি ব্যথা পেয়েছি। 

ছোটোবেলায় আর বড়বেলায় দু বেলাতে আমি বোধহয় ২-৩ বার মার খেয়েছি। যতটুকু মনে পড়ে- যারা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে, বাড়ির কাজ আনে, পড়া পারে, তাদেরকে শিক্ষকরা খুব কমই মারে। এরা মার খায় দুষ্টামির জন্য। আর বাকিরা মার খাইতো পড়া আর হাতের লেখার জন্য। 

এবার আমার অভিজ্ঞতা( তিক্ত ও মিষ্টি দুটোই) শেয়ার করি- 

প্রথম মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সেরা ঘটনার একটি। এই ঘটনা না ঘটলে বুঝতাম না যে, শিক্ষকের শাসনের মাঝেও কতটা স্নেহ-ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। 

আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে। ছাত্রী হিসেবে ভালোই ছিলাম। প্রতিদিন পড়া শিখতাম। হাতের লেখাও আনতাম। একদিন ক্লাসে বসে আছি। আমার আশেপাশের সবাই সেদিন ইচ্ছেমতো চিৎকার চেঁচামেচি করছিলো। যতরকম শয়তানি আর বাঁদরামি আছে। সব। আমি সেখানে শুধু বসেই ছিলাম। কি যেন লিখছিলাম। আমার সামনের বেঞ্চ ও পিছনের বেঞ্চে ছিলো দুটি শয়তানের গ্রুপ। তারা খুব শয়তানি করছিলো।

এমন সময় মোটা এক বেত নিয়ে আমাদের বুড়া স্যার(স্কুলের সবচে বয়স্ক স্যার।) ক্লাসে এসেই সবাইকে এলোপাতারি মারা শুরু করলেন। ২-৩ টা আমার পিঠেও পড়েছিলো। এতো ব্যথা!! মনে হচ্ছে- এখনো ব্যথা করছে। আমি তো বসে বসে চোখের জল ফেলছিলাম। শুধু আমি না বলতে গেলে সবাই। স্যার তো মেরেই চলে গেলেন। একটু পর টিফিন পিরিয়ড। সবাই বের হবে, এমন সময় স্যার আবার আমাদের ক্লাসে এলেন। স্যারকে দেখে সবাই আবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে গেলো।

স্যার আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বল্লেন,”মনি, খুব ব্যথা পেয়েছিস? আমি তো দেখি নাই রে এটা যে তুই ছিলি? আহা রে! কিছু মনে করিস না।” প্রথমে মার খাওয়ার পর খুব কষ্ট পেয়েছিলাম মনে। কিন্তু স্যার যখন এসে কথাগুলো বললেন, তখন সব ব্যথা দূর হয়ে গেলো। স্যার যে আমাকে এতো ভালোবাসতেন আমি সেদিনই বুঝেছি। 

তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে। ক্লাসে বিজ্ঞান ম্যাডাম পড়া দিয়েছেন,”মাদা তৈরির উপায়।” ম্যাডাম এমনিতে বেশ হাসিখুশি ছিলেন, তবে পড়া না পারলে ঘষেটি বেগমের চাইতেও স্বার্থপর হয়ে উঠেন। আল্লাহর রহমতে সসেদিন আমি পড়া শিখে যাই নি। তো ম্যাডাম যথারীতি পড়া ধরলেন। অনেকেই পারে না। আমিও না। ম্যাডাম যারা পারে না, তাদেরকে মারতেছেন আবার ক শাখা থেকে খ শাখায় ট্রান্সফার করতেছেন। কী ঝামেলা!

মান-সম্মান আর থাকবে না। ম্যাডাম আমাকে নাম ধরে ডাকতেছেন। আমি ভয়ে ভয়ে যাচ্ছিলাম। আমার হাঁটার স্টেপ দেখেই ম্যাডাম বুঝলেন- আমিও না পারার দলে। এরপর ম্যাডাম তার সর্বোচ্চ শক্তি একত্রে করে আমার হাতে অতিরিক্ত চারটি ভাগ্যরেখা এঁকে দিলেন। আর বললেন, “সোজা খ শাখায় চলে যাও।” আমি বের হবো ঠিক এমন সময় টিফিনের ঘন্টা বাজলো। সেদিন আল্লাহর প্রতি লাখো-কোটি শুকরিয়া প্রকাশ করেছি। 

 তৃতীয় মার খাওয়ার ঘটনাও প্রাইমারিতে। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে। রোল নাম্বার ৩। আমরা যারা বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছি তাদেরকে আলাদা করে কোচিং করানো হতো। একদিন ভগ্নাংশের একটি অংক। হর ১০ ও লব ১০। এটাকে সহজে কাটাকাটি করা যায়। আমি বারবার প্রচলিত নিয়মে করতেছি।

স্যার যতবার আমাকে বলছেন,”ঠিক করে কর। নয়তো আজকেই তোকে থ্রিতে নামিয়ে দিবো।” পরপর তিনবার আমি অংকটি প্রচলিত নিয়মেই করছি। এরপর আমার জীবনের সবচে বিবৎস ঘটনা। স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন, অফিস রুমে। সেখানে নিয়ে আমার হাতে ২-৪ টা দিচ্ছেন আর বকছেন। খুব কষ্ট পেয়েছি। স্যারের উপর না। নিজের উপর। কেন যে এতো সহজ অংকটা পারছিলাম না। 

চতুর্থ ঘটনা খুব বড়কালে। তখন অষ্টম শ্রেণিতে। একদিন ক্লাসে স্যার Load shedding প্যারাগ্রাফ পড়া দিয়েছেন। আমি পারি না। আহা!! যেই আমি প্রতিদিন স্যারের পড়া সবার আগে বলতাম, সেদিন আমি পড়া বলার ভয়ে একদম লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। মনে মনে দোয়া পড়তেছি আর সময় দেখতেছি। কখন ঘন্টা বাজবে। হায়! হায়! আজকে দেখি ঘণ্টাও বাজে না। ইচ্ছে করছিলো নিজেই গিয়ে বাজিয়ে আসি।

২-৪ জনের কাছ থেকে পড়া নেওয়ার পর স্যার আমাকে ডাকলেন। স্যারের কাছে গিয়ে যখন আমতা আমতা করছিলাম,স্যার তখনই হাতে মারতে মারতে বলতে লাগলেন,” তোমারে পিছনে দেখেই বুঝছি, ডালমে কুছ কালা হ্যায়।” সেই মারের কয়েকদিন পরেই স্যার মারা গেলেন। এখনো খুব কষ্ট লাগে। আর মাঝে মাঝে ব্যথাও পাই। 

অনেকেই হয়তো লেখাটা পড়ে ভাববেন, আমাদের স্যারেরা বোধহয় খুব নিষ্ঠুর  প্রকৃতির ছিলো। তাহলে বলবো আপনি ভুল ভাবছেন। আমাদের স্যারেরা আমাদের নিজের সন্তানের মতোই আদর যত্ন করতেন স্কুলে। মাঝে মাঝে একটু শাসন করতেন। এই শাসন না পেলে হয়তো আজকে নিজেও একজন শিক্ষক হতে পারতাম না। স্যারেরা আমাদের কোচিং করাতেন ফ্রীতে। এছাড়া আমার মতো অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীকে বিনা খরচে পড়ার সুযোগ ও টিউশনেও কোনো টাকা নিতেন না। 

সেই স্যার ও ম্যাডামদের সাথে আজও দেখা হলে সালাম দিলেই চট করে নামটা বলে দেন। হেসে কথা বলেন। খোঁজ-খবর নেন। জড়িয়ে ধরে কথা বলেন। সেই আগের মতো। তারা সত্যিই মহৎ- উদার।  

Related Posts

13 Comments

মন্তব্য করুন