বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু

শিশু মৃত্যুহার হলাে প্রতি বছরে জীবিত জনাগ্রহণকারী প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা।
বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬৫০ জন। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ৫৭৪ জন, ২০০১ সালে ৩২২ জন এবং ২০১০ সালে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা কমে ১৯৪ জন হয়। বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী
২০১৫ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৭৬ জন (প্রতি লক্ষে)।

আমাদের দেশে বাল্য বিবাহের কারণে মেয়েরা অল্পবয়সে গর্ভধারণ করে। গর্ভকালীন সময়ে, অবহেলা,
অজ্ঞতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রভৃতি কারণে মায়েরা প্রয়ােজনীয় পুষ্টি পায় না। ফলে তারা মাতৃত্বকালীন।
ননা জটিলতায় ভােগে এবং মৃত্যুবরণ করে। তাছাড়া মাতৃমৃত্যুর ‘আরাে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন-
নিম জীবনযাত্রা, বিশুদ্ধ পানির অভাব ও দুর্বল সেনিটেশন ব্যবস্থা, নারী শিক্ষার অভাব, চিকিত্সার অভাব, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত, প্রসবকালীন উচ্চ রক্ত চাপ, একলেমশিয়া প্রভৃতি।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর কারণে শিশু প্রয়ােজনীয় পুষ্টি হতে বঞ্চিত হয়। ফলে শিশু রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলে নানা রােগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুবরণ করে। মাতৃহারা শিশুর সুষ্ঠু
সামাজিকীকরণে সমস্যা হয়। মাতৃমৃত্যুর কারণে সদ্য জন্মগ্রহণকারী শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প দুধের প্রয়ােজন হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রেই শিশু পেটের পীড়া কিংবা অন্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। দরিদ্র পরিবারের জন্য এই অর্থ খরচ একটি বড়তি চাপ। অনেক ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যু পারিবারিক বিশৃঙ্খলতার অন্যতম কারণ। শিশুর প্রতি পিতার অধিকতর যত্নশীল ভুমিকা
মাতৃমৃত্যুর প্রভাব লাঘবে সহায়ক হতে পারে।বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু পরিস্থিতি
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু ঘসে উল্লেখযােগ্য সফলতা অর্জন করেছে। ২০০৮ সালে ইউনিসেফ প্রকাশিত এক রিপাের্টে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে এদেশে শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৪৯ জন, ২০০৬ সালে এ
সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬৯ জনে। ২০০৮ সালে শিশু মৃত্যুর হার আরাে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০১৪
সালে শিশু মৃত্যু হার আরাে হ্রাস পেয়ে হয় ৩০ জন। সুতরাং বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযােগ্য হারে হ্রাস পেলেও উন্নত দেশসমূহের তুলনায় এ হার অনেক বেশি।

বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনও দরিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। ফলে মা ও শিশু সঠিক স্বাস্থ্য সেবা, পরিচর্যা পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মূলত দারিদ্র্যের কারণেই শিশুদের একটা অংশ মৃত্যুবরণ করে। তাছাড়া এদেশে এখনও বাল্য বিবাহের প্রচলন রয়েছে। গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারগুলােতে ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সের মধ্যে একটা বিরাট সংখ্যক মেয়ের বিবাহ হয়ে যায়। ফলে অল্প বয়সে গর্ভধারণ করায় সন্তান দুর্বল ও পুষ্টিহীন হয়। অনেক সময় শারীরিক জটিলতায় এসব
শিশু মৃত্যুবরণ করে। এখনও এদেশে গ্রাম্য প্রশিক্ষণহীন ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসব হয় যা শিশু মৃত্যুর হারকে বাড়িয়ে দেয়। আবার মায়ের অপুষ্টি ও অসুস্থতার কারণে অনেক সময় শিশুরা অপুষ্টিতে ভােগে।
অপুষ্টির কারণে বিভিন্ন রােগ হয়। ফলে অনেক শিশু মৃত্যুবরণ করে।
আমাদের দেশে হাম, পােলিও, যক্ষা, ধনুস্ট্রংকার, ডিপথেরিয়া ও হুপিং কাশি প্রভৃতি রােগে শিশু মৃত্যুর
হার কমলেও এখনও এর প্রভাব কোনাে কোনাে অঞ্চলে রয়েছে। এর কারণেও শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে।
প্রয়ােজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অভাব, প্রাম ও শহরের চিকিৎসা সুযােগ সুবিধর তারতম্যের কারণে এদেশে গ্রামীণ এলাকায় শিশু মৃত্যুর হার বেশি। তাছাড়া অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং অবহেলার কারণেও শিশু
মৃত্যু ঘটে থাকে। এদেশের ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও শিশু মৃত্যু ঘটে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল
এ ঘূর্ণিঝড়ে ও জলােচ্ছ্বাসে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল যার শতকরা ৫০ ভাগই ছিল শিশু।

পরিবারে শিশু মৃত্যুর ঘটনা খুবই দুঃখজনক। পরিবারে শিশু মৃত্যুর ঘটনার সাথে আমরা কেউ কেউ পরিচিত। একটি পরিবারে যখন একটি শিশু মারা যায় তখন ঐ পরিবার অনেকটা অগােছালাে হয়ে যায়
এই পারিবারিক শােক সামলানাে কষ্টকর হয়ে পড়ে।
শিশু মৃত্যুর উচ্চ হার দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বাধা সৃষ্টি করে। শিশুর মৃত্যুজনিত কারণে পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। যা পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির স্বাভাবিক কাজ কর্মে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে পরিবারটিও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই আমাদের শিশু
মৃত্যু বিষয়ে সচেতন হতে হবে। শিশু মৃত্যু প্রতিরােধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

Related Posts

7 Comments

মন্তব্য করুন