হরর ও ফ্যান্টাসি জনরার অসাধারণ একটি বই ‘এটিকুয়েটা’

“বুক রিভিউ”
বইয়ের নাম: এটিকুয়েটা
লেখিকা: নীলা মনি গোস্বামী
প্রকাশক: বদরুল মিল্লাত
প্রকাশনী: নহলী
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২০
প্রচ্ছদ মূল্য: ২৩০ টাকা/-

হরর বই হিসেবে বইটি কখনোই নির্জন মধ্য দুপুর কিংবা রাতের বেলায় একা পড়া সহজ হবে না। প্রতিটা পাতায় গা শিউরে দেওয়ার মতো ব্যপার রয়েছে বইটিতে।
মূলত এটি একটি হরর ও ফ্যান্টাসি জনরার গল্প সংকলন। বইতে দশটি ভিন্ন ভিন্ন চমৎকার গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘এটিকুয়েটা’।

১। প্রথম গল্পটি হচ্ছে দেবতা। ত্রপাদের গ্রামে প্রতি দশ বছর পর পর এক দেবতার অভিশাপ নেমে আসে। গ্রাম জুড়ে খরা আর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়৷ বৃষ্টি হয় না, ফসল ফলে না, ঘরে ঘরে মানুষ মশা-মাছিদের মতো মরতে থাকে! দেবতাকে তখন সন্তুষ্ট করার জন্য নরবলি দিতে হয় ! মানুষের তাজা রক্ত যখন দেবতার গায়ে পড়ে, তাদের মৃত্যু চিৎকারে গ্রামের আকাশ বাতাস যখন থরথর করে কেঁপে উঠে, তখন শান্ত হন দেবতা। গ্রামের ওপর নেমে আসে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। গ্রামের মানুষজন সে বৃষ্টিতে মন ভরে ভিজে নেয়। কিন্তু নরবলি দেওয়ায় পুলিশি সমস্যার জন্য সে যায়গায় তারা একটা অদ্ভুত বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু আসলে সেখানে নিসংস বলির কাজই করা হয়ে আসছিল। গল্পটির একদম শেষে অনেক বড় টুইস্ট আছে। যা গল্পের মোড় ঘোরাতে সফল। সেটিই আমার সবথেকে ভালো লেগেছে।

২। ছলনা গল্পে একটি মেয়ের সাথে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। তার বান্ধবী রিতা তাকে পুকুর পাড়ে আসতে বলে। কিন্তু অনেক সময় অপেক্ষার পরও সেখানে রিতা আসে না। তারপর তার আশেপাশের পরিবেশ অন্ধকার হয়ে আসে। তার মনে পড়ে রাতে দাদি বলেছিল আজকের রাতটা অভিশপ্ত। তান্ত্রিক ও কালো যাদুসাধকেরা এই রাতে মানুষেদের ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দেয়। অন্ধকার জগতের মৃত আত্মারা নেমে আসে পৃথিবীতে। তাই কেউ এই রাতে ঘর থেকে বের হয় না। কিন্তু সে তো বের হয়ে এসেছে! তার সাথে এটা কী ধরনের ছলনা ঘটতে যাচ্ছে?
ছোট একটি গল্প কিন্তু ঘটনার বর্ননায় অনেক চমৎকারভাবে ভয় লেগে যায়।

৩। জিভে তিল থাকলে যা হয়! কী হয় জানেন? ওরা যা বলে তাই সত্যি হয়। এমনই বলা হয়েছে এই গল্পে। রিয়া মেয়েটার জিভে তিল আছে। তার বান্ধবী তাকে জানায়, রাত বারোটার পর সেলাইবিহীন নতুন কাপড় পরে সাদা জবা হাতে খোলা আকাশের নিচে পদ্মাসনে বসে টানা সাতদিন ভোর হওয়া পর্যন্ত ধ্যান করতে হবে। আর একটা বিশেষ মন্ত্র তাকে জানাই সেটা পড়লেই জাগ্রত হবে তিলের শক্তি। ঋতা সব কাজ সম্পন্ন করে। এবং ফলস্বরূপ জাগ্রত হয় তার জিভের তিলের শক্তি। কিন্তু এটাই তার জন্য কাল হয়ে। তার মুখের কথা সব সত্যি হতে শুরু করে। ঘটনা ক্রমে তার এই কথার জন্য তার মার মৃত্যু হয়। কিন্তু সে তার ওই বান্ধবীর তাদের কাছ থেকে জানতে পারে তার মাকে সে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আনতে পারে। কিন্তু কাজটা খুবই ভয়ংকর এবং অনেক কঠিন। তবে রিতা ঠিকই তার মাকে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু মৃত্যু তাদের পিছু ছাড়েনি। সব সময় তাদের তাড়া করে বেরিয়েছিল। তাই তাদের কখনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকা হয় না। তারাও মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ায়। কিন্তু মৃত্যুর থেকে তারা কত দিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে?
গল্পটিতে অতিপ্রাকৃত ও প্রেত তন্ত্রের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। সাথে একটা অসাধারণ পরিণতির গল্প।

৪। আমার বাবা গল্পটি ভৌতিক জনরার না। এটি একটি সায়েন্স ফিকশন বলা যায়। গল্পটিতে বৈজ্ঞানিক ছেলে ভবিষ্যৎ থেকে তার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফিরিয়ে আনে। যাতে সেই সময় তিনি যে রাজাকার ছিলেন সেই ভুলটা শুধরে নিতে পারেন। টাইম মেশিন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা এই গল্পটি অবশ্যই আপনার মনে দাগ কাটতে সফল হবে। গল্পটির শেষে একটা করুণ পরিণতি দেখা যায়।

৫। তমা নামের মেয়েটি অদ্ভুত। সে সবসময়ই ভূত প্রেত এবং প্যারানরমাল বিষয় নিয়ে চর্চা করে। একসময় তাই তাকে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। হোস্টেলে সে তারই মত এই ব্যাপারে আগ্রহী একটি মেয়ের সাথে পরিচিত হয় যার বাবা অনেকদিন ধরে এই প্যারানরমাল বিষয়গুলো চর্চা করে। সেখান থেকে সে এই ব্যাপারে আরও আগ্রহী হয়ে। কিন্তু এটাই সময় তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তারা এক ধরনের পানীয় লোভে একটি বিশেষ জগতে প্রবেশ করে। সেই পানির মধ্যে ছিল অমরত্ব, আজীবন যৌবন ধরে রাখার মতো শক্তির উৎস। কিন্তু তোমার ভুলের জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া তার ওই বান্ধবীকে প্রাণ হারাতে হয়।
গল্পটির লোমহর্ষক বর্ণনা এবং পরিণতি অসম্ভব উপভোগ্য। এবং শেষে একটা রহস্য থেকেই যায়। তোমাকে সেই পানীয় লাভ করতে পেরেছিল?

৬। বিয়ের পর মেয়েটি বুঝতে পারে তার স্বামী আবির সাধারণ নয়। তার সাথে একটি শাকিনী থাকে। সাকিনি হল নরক থেকে নেমে আসা ঘৃণিত বিদঘুটে একটা জন্তু। যার গায়ের রং ফ্যাকাসে, দেহ ভর্তি দগদগে ঘা, শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে পোকা বের হয়ে আছে। ছোটবেলায় একটি অভিশপ্ত গাছের পাতা চেনার কারণে এই আবিরের ওপর ভর ভর করেছে। শুধু তার স্ত্রী পারে তাকে রক্ষা করতে। সত্যিকারের ভালোবাসা সেই শাকিনী কে প্রতিহত করতে পারে। গল্পটির বর্ননা ও গল্প উভয় অসাধারণ।

৭। এমন একটি বাড়ি যেখানে সবাইকে পরিবারের মতো মিলেমিশে থাকতে হয়। এটাই বাড়ির মালিকের নিয়ম। ঢাকা শহরে অনেক কম ভাড়ায় বাসা পাওয়ার ফলে সেখানে চারজন বান্ধবী থাকতে শুরু করে। কিন্তু একদিন অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটে। তাদের কারণে এক বান্ধবীর মৃত্যু হয় এবং তারা পুলিশের থেকে বাঁচার জন্য তার লাশটিকে কেটেকুটে টুকরো করে ফেলে দেয়। কিন্তু বাড়িওয়ালার নিয়ম ছিল তাদের মিলেমিশে থাকতে হবে। তারা ফ্যামিলির নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলেছে তাই বাড়িওয়ালার আত্মা তাদের কাউকেই আর ছাড় দেয়নি। গা শিউরে ওঠা একটা ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে গল্পটিতে।

৮। নরকের প্রভু পেমনকে সন্তুষ্ট করতে পারলে সে তার ভক্তদের মন ভরে উপহার দেন। এখান নামের একটি মেয়ে প্রভু পেমনের প্রেমে পড়ে যায়। এবং আহ্বান করে তাকে। আহবান এর জন্য তিনটি প্রাণীর মাথা উৎসর্গ করতে হয়েছিল। সে পেমনের আছে তাকেই প্রিয়তম হিসেবে চাই। প্রভু বলে তার গর্ভে যে সন্তান আসবে সেটাই সে হবে। দশ বছর পর্যন্ত তাকে আগলে রাখতে হবে। কিন্তু ইথার সেটা পালন করতে পারে না। সে অন্য একজনের প্রেমে পড়ে এবং পালিয়ে যেতে চায়। পালিয়ে যাওয়ার আগে প্রভুর সেই সন্তানকে সে হত্যা করে কুকুরকে খাইয়ে দেয়। তার ফলে তার সাথে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যায়। গল্পটি শেষে এমন একটা ধাক্কা দেখা যায়, সেটা অবশ্যই চমৎকার।
৯। ছোট মেয়েদের বিভিন্ন কল্পনার জগত থাকে। জাদুর গাছ গল্পে, তুলিকে একটি লোক আশ্চর্য এক ফল দিয়ে বলে এই ফলটি রাত বারোটার পর খেয়ে যদি বিজ মাটিতে রোপন করে তাহলে একটু জাদুর গাছ জন্ম নেবে। সেই গাছের কাছে যা চাওয়া হবে তাই পাওয়া যাবে। তুলির কথা কেউ বিশ্বাস না করলে শেষ ঠিকই সেই ফল খেয়ে বীজ রোপন করেছিল এবং তা থেকে আশ্চর্য এক গাছ জন্ম নেয়। ফ্যান্টাসি জনরার গল্পটি কিছুটা শিশুতোষ।

১০। সবশেষে আসে মেইন গল্প এটিকুয়েটা। অহক নামের ছেলেটি কোভেনের সাথে যুক্ত। কোভেন হলো প্রেত বা যাদুচর্চাকারী দল। বিভিন্ন স্পেল বা মন্ত্রের চর্চা করে তারা। একটি মেয়ের অহকের সাথে পরিচয় হয়। তার আশ্চর্যকর প্যারানরমাল গল্পগুলো মেয়েটির শুনতে ভালো লাগে। অহক তার প্রাক্তন পরীর ছাড়াছাড়ি ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা জানায়। একটা ভুল স্পেলের কারণেই সবকিছু ঘটে। একসময় মেয়েটা অহকের প্রেমে পড়ে যায়। একদিন অহক তাকে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে একটা বিশেষ চক্রে বসায়। একটা ভয়ানক প্লান করেছিল সে। ল্যাটিন বই ‘এটিকুয়েটা’ থেকে যে মৃত মানুষকে জীবিত করার স্পেলটা শিখেছে সেটায় প্রয়োগ করবে তার ওপর। এবং তার দেহে পরীর আত্মা স্থাপন করা হবে। শেষ পর্যন্ত পরী কোনোভাবে বেঁচে যায়। কীভাবে! সেটা চমৎকার একটা টুইস্ট। গল্পটা সত্যিই অসাধারণ। তাই অবশ্যই পড়বেন এটিকুয়েটা বইটি।

পারসোনাল রেটিংস: ৯/১০।
অনলাইন প্রাপ্তিস্থান নহলী বুকস ও রকমারি.কম
বইটি অবশ্যই পড়বেন আপনারা। বই মানুষের প্রিয় বন্ধু। বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন ও বেশি বেশি বই পড়ুন। ধন্যবাদ।

রিভিউ লেখকঃ আজফার মুস্তাফিজ

Related Posts

10 Comments

মন্তব্য করুন