কাসাভা আলু আমাদের দেশে একদম নতুন মনে হলেও কিন্তু মোটেও নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই আলুটি পার্বত্য এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষ হয়ে আসছে। কাসাভা আলু দেখতে অনেকটা মিষ্টি আলুর মত। পাহাড়ি ও গ্রামীণ এলাকায় কাসাভা আলুকে সবাই শিমুল আলু বলে থাকে।
কাসাবা আলুর গাছের পাতা দেখতে শিমুল গাছের মত বলে এর নামকরণ করা হয়েছে শিমুল আলু। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Manihot Esculenta। কলম্বিয়া থেকে এই আলুটির উৎপত্তি বলে জানা যায়। আফ্রিকা মহাদেশের কাসাভা সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে।
কাসাভা আলু চাষ পদ্ধতি
কাসাভা বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া অঞ্চল কাসাভা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। পাহাড়ের জুমচাষে এই আলুটি ব্যাপকভাবে চাষ হয়ে থাকে। পাহাড়ের উঁচু মাটি ও বেলে দোআঁশ সব জায়গায় এই কাসাভা আলু চাষ করা হয়।
কাসাভা জলাবদ্ধতা এবং উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে পারেনা। জমিতে পানি জমে থাকলে গাছ পছে মারা যায়। অন্যান্য ফসলের মত কাসাভা গাছেরও ফুল ও ফল ধরে। কিন্তু ফল থেকেই এই আলু চাষ করা হয় না। কাসাভা ফল থেকে চাষ করতে গেলে গাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে। তাই কাসাভা গাছের কাটিং জমিতে রোপণ করে চাষ করতে হয়।
শীতকালে কাসাভা আলু তোলার উপযুক্ত সময়। কাসাভা আলু তোলা শেষ হয়ে গেলে সেই গাছের ২/৩ ফুট উচ্চতা করে কেটে এর কাটিং ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় পুঁতে রাখতে হয়। তারপর গ্রীষ্মকালের এর শেষের দিকেই এপ্রিল মে মাসে এই কাটিং তুলে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। আর কোনো বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না।
কাসাভা আলু রান্না পদ্ধতি
স্বাদে গন্ধে ভরপুর কাসাভা আলু বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া যায়। যেমন-
১.কাসাভা আলু আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া যায়।
২. পানিতে সিদ্ধ করে খাওয়া যায়।
৩. সবজি হিসেবে রান্না করে।
৪. ভাজি করে,চিপস বানিয়ে।
প্রিয় পাঠক, আজকে আমি কাসাভা আলুর উপরের ৪ টি ভিন্ন ভিন্ন চমৎকার রেসিপি নিয়ে আলোচনা করবো।
১. কাসাভা আলু আগুনে পুড়িয়ে
কাসাভা আলু আগুনে পুড়ে খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। পৌষ মাসে তীব্র শীতের সকালে গ্রামের লোকেরা কাঠ,বাঁশ লতাপাতা দিয়ে একসাথে আগুন পোহায়। সেই শীতের মিষ্টি সকালে কাসাভা আলু পোড়া খেতে ভীষণ মজা লাগে। তো কথা বাড়িয়ে কিভাবে কাসাভা আলু আগুনে পুড়ে খাওয়া যায় সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
প্রথমে কাসাভা আলুর বাকল পরিষ্কার করে তুলে ফেলি। এবার ভিতরে আলুতে পিচ্ছিল পদার্থ থাকে সেটাকে পরিস্কার কাপড় দিয়ে ভালোভাবে মুছে ফেলুন যাতে আলুর গাঁয়ে বেশি ছাই না লাগে। এবার আলুটি ২ থেকে ৩ ইঞ্চি সাইজ করে কেটে নিন। যদি আলুটি বড় হয় মাঝখান বরাবর দুই ভাগ করে কেটে ফেলুন যাতে ভেতরের অংশটি আগুনের তাপে মিলে যায়। এবার আলুর টুকরোগুলো আগুনে তাপে দিন।
খেয়াল রাখবেন বেশি আগুনে দেবেন না তাহলে আলু পুড়ে যাবে। কিছুক্ষণ ৬ থেকে ৭ মিনিট আগুনে দেয়ার পর লক্ষ্য করবেন আলু নরম হয়ে গেছে। তার মানে বুঝতে হবে কাসাভা আলুর খাওয়ার উপযুক্ত। যদি আগুনে বেশি পুড়ে যায় তাহলে দা অথবা বঁটি দিয়ে পড়া অংশটি চেঁছে ফেলুন। গরম অবস্থায় খেতে খুব সুস্বাদু লাগে।
২. পানিতে সিদ্ধ করে খাওয়া
কাসাভা আলু পানিতে সিদ্ধ করে খেতে সেই মজা লাগে। পানিতে সিদ্ধ করে খেতে চাইলে আগে আলু গুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে নিন। এবার একটি পাত্রে পানি দিয়ে আলুর টুকরোগুলো চুলায় বসিয়ে দিন। স্বাদ অনুযায়ী লবন দিন। চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে পাত্রে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন।
৮ থেকে ১০ মিনিট সিদ্ধ করার পর চামচ দিয়ে নাড়িয়ে দেখুন সিদ্ধ হইছে কিনা? যদি নরম মনে হয় তাহলে পাত্রটি চুলা থেকে নামিয়ে ফেলুন। বেশি সিদ্ধ করা যাবে না তাহলে আলু গলে যাবে।
৩. সবজি হিসেবে রান্না করে
কাসাভা আলু সবজি হিসেবে রান্না করে খেতে অন্যান্য সবজির মতো একি উপকরণ লাগে। যেমন- লবন, পেঁয়াজ বাটাকাঁচা মরিচ, হলুদের গুঁড়া, সরিষার তেল, ছোট সাইজের চিংড়ি মাছের শুঁটকি ইত্যাদি। তবে খেয়াল রাখবেন কাঁচা মাছ, রসুন ও মশলা বেশি দেয়া যাবেনা। না দিলেও চলবে।
প্রথমে বাকল চিলে আলুর সাইজ টুকরো টুকরো করে কেটে নিন। টুকরো করার আগে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এবার একটি পাত্রে সরিষার তেল গরম করে নিন। তারপর একটি পেঁয়াজ কুচি করে তেলে ভাজুন। বেশি ভাজবেন না যাতে পেঁয়াজ পুড়ে না যায়। পেঁয়াজ ভাজা হয়ে গেলে পাত্রটি চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
এবার টুকরো করে কাটা আলুগুলো পাত্রে ঢেলে দিন। এরপর সমস্ত উপকরণ তেল,লবন, হলুদ, মরিচ একসাথে মিশিয়ে নিন। তারপর পাত্রটি চুলায় বসিয়ে দিয়ে কাটি দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে থাকুন যাতে আলুর গাঁয়ে মিশে যায়। ২ থেকে ৩ মিনিট পর লবন, হলুদ, মরিচ গুঁড়া আলুর সাথে মিশে গেলে এবার পরিমান মত পানি দিন।
তারপর পাত্রটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে ৮ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এবার চামচ দিয়ে দেখুন আলু সিদ্ধ হয়েছে কিনা যদি নরম হয় তাহলে বুঝতে হবে রান্না শেষ। সবশেষে এবার ধনিয়া পাতার কুঁচি দিয়ে দিন। মনে রাখবেন, ধনিয়া পাতার কুঁচি আলুর সংবাদকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে।
৪. ভাজি করে, চিপস বানিয়ে
কাসাভা আলু যদি রান্না করে খেতে ভালো না লাগে তাহলে আপনি ভাজি করে অথবা চিপস বানিয়ে খেতে পারেন। যদি ভাজি করে খেতে চান তাহলে আগে আলুর সাইজগুলো ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিন।
তারপর গরম পানি দিয়ে হালকা সিদ্ধ করে ফেলুন। এবার যেভাবে মন চায় সেভাবে ভাঁজুন। এছাড়াও কাসাভা আলু দিয়ে পাঁপর, চিপস, নুডলস, ক্র্যাকার্স, বিস্কুট, কেক, পাউরুটি ইত্যাদি সুস্বাদু খাবার তৈরি করা যায়।
কাসাভা আলু পুষ্টিগুণ
কাসাভা আলুতে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান তা হল শর্করা। কাসাভায় অতিরিক্ত শর্করা থাকায় অন্যান্য আলুর তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টি বিদ্যমান। প্রতি ১০০ গ্রাম কাসাভায় রয়েছে-
– শর্করা = ৩০.৪০ গ্রাম
– প্রোটিন= ১.২ গ্রাম
– আমিষ = ১.২ গ্রাম
– চর্বি = ০.৩ গ্রাম
– ক্যালসিয়াম = ০.৩৫ মিলিগ্রাম
– আয়রন = ০.৭ মিলিগ্রাম
– ভিটামিন এ = ০.৯ মিলিগ্রাম
– ভিটামিন সি = ০.৭ মিলিগ্রাম
– খাদ্যশক্তি = ০.১৬৭ ক্যালরি
সবকিছু পুষ্টিগুণ মিলে কাসাভা আলু বহির্বিশ্বে তিন নাম্বার আলু হিসেবে স্থান লাভ করেছে। সঠিকভাবে চাষাবাদ করলে এই আলুটি অদূর ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখবে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাসাভা আলু থেকে আটা ও স্টার্চ তৈরি করে বিভিন্ন প্রকার বিস্কুট বানিয়ে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।