কালাভুনা রেসিপি
গরুর মাংসের কালা ভুনা নামটা শোনার সাথে সাথে ভজন প্রেমীদের একটা ফ্যান্টাসি জেগে উঠে। আমাদের অনেকেরই একটা কনসেপ্ট আছে যে কালা ভুনা মানে মাংস টাকে ভেজে কালো করে সেটাকে খেতে হবে। ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম না। কালা ভুনা মাংস টি রান্নার পরে এত সফট হবে যে একটু চাপ দিলেই হাড় থেকে মাংস গুলো আলাদা হয়ে যাবে। মাংসের টুকরোগুলো যদি কাটতে যাই তাহলে খুবই স্মুথলি এটা কেটে যাবে। কালা ভুনা মানে কোন ভাজা বা পোড়া মাংস নয়। অনেকেই আছেন যারা রান্না মাংসকে মসলা সমেত তেলের মধ্যে ঢেলে করকরে করে ভেজে কালো করে সেটাকে বলছেন কালা ভুনা। আবার কেউ কেউ ভুনা মাংসকে কালো করার জন্য ডার্ক সয়াসস ঠেলে দিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে করে রান্না করা মাংস আসলে কালাভুনা নয়। কালা ভুনা রান্না একেকজন একেকভাবে করে থাকেন। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের জনপ্রিয় খাবার গুলোর মধ্যে অন্যতম গরুর মাংসের কালা ভুনা রান্নার সহজ রেসিপি নিয়ে আজকে আলোচনা করবো।
তৈরী করতে যা যা লাগবে:
১) ১ কেজি হাড্ডি এবং চর্বি সহ গরুর মাংস
২) মাঝারি সাইজের চারটি পেঁয়াজ
৩) সরিষার তেল
৪) চারটি শুকনা মরিচ
৫) দুই টেবিল চামচ পরিমাণ আদা রসুন বাটা
৬) এক চা চামচ ধনিয়া গুঁড়ো
৭) এক চা চামচ জিরা গুঁড়ো
৮) হাফ চা চামচ ভাজা জিরা গুঁড়ো
৯) হাফ চা চামচ হলুদের গুঁড়ো
১০) দুই চা চামচ মরিচের গুঁড়া
১১) পরিমান মত লবন
১২) বড় দুই থেকে তিনটি গরম মসলা
১৩) ছোট সাইজের চারটি তেজপাতা
১৪) দুইটি স্টার এনিস মসলা
১৫) চার থেকে পাঁচটি এলাচ
১৬) গোলমরিচ
১৭) দুটি কালো এলাচ
১৮) তিন থেকে চারটি লবঙ্গ
১৯) এক টেবিল চামচ টক দই
২০) হাফ চা চামচ রাধুনী গুঁড়ো
২১) হাফ চা চামচ জয়ফল এবং জয়ত্রীর গুঁড়ো
যেভাবে রান্না করবেন:
গরুর মাংসের কালা ভুনা করার জন্য একটি প্যানে এক কেজি গরুর মাংস রাখতে হবে। চেষ্টা করবেন হাড্ডি এবং চর্বি সহ মাংস নিতে। মাংসগুলো মাঝারি সাইজের কেটে নিতে হবে। বেশি ছোট করে কাটার দরকার নেই। এতে করে রান্নার পর একেবারে ছোট হয়ে যেতে পারে। আবার বেশি বড় করে মাংস কাটলে ভেতরটা নরম হয় না।
এখন মাংসগুলোকে মাখাতে হবে। প্রথমেই দুটো মাঝারী সাইজের পেঁয়াজ মোটা কুচি করে মাংসের ওপর ঢেলে দিতে হবে। সেই সঙ্গে দেড় টেবিল চামচ পরিমাণ আদা রসুন বাটা। আর মসলার মধ্যে এক চা-চামচ ধনিয়া গুড়ো, এক চা-চামচ জিরা গুড়ো, হাফ চা চামচ হলুদের গুঁড়ো এবং মরিচের গুঁড়ো আপনার পছন্দ অনুযায়ী নেবেন। তবে কালাভুনাটা একটু ঝাল ঝাল হলে বেশি ভালো লাগে। সেজন্য দুই চা চামচের একটু বেশি মরিচের গুঁড়ো নিলে ভালো হয়। এরপর পরিমাণমতো লবণ এবং গোটা গরম মসলা। কাল ভুনা রান্নার প্রথমেই গরম মসলা দিতে হয় না। রান্না শেষে গরম মসলা দিতে হবে। ছোট সাইজের চারটি তেজপাতা, অল্প কিছু গোলমরিচ, চারটি এলাচ যেগুলোর মাথা গুলো একটু ভেঙে নিতে হবে, দুটো কালো এলাচ, তিন-চারটা লবঙ্গ, দুটো স্টার মসলা। স্টার মশলা হলো স্টার আকৃতির একটি সুগন্ধি মশলা, এ মশলার গাছটি চিরসবুজ মাঝারি ধরনের যা Magnolia পরিবারের অন্তর্গত। যদি একান্তই এই মসলা না থাকে তবে এটি না দিলেও হবে তবে এটি দিলে খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ হয়। এইসব কিছু মাংস গুলোর উপর ঢেলে দিয়ে ১/৩ কাপ তেল দিতে হবে। তেলটি অবশ্যই সরিষার তেল হতে হবে সয়াবিন তেল হলে হবে না। তারপর এটাকে খুব ভালোভাবে মাখিয়ে নিতে হবে। যত ভালো করে মাখাবেন কালাভুনার টেস্ট ততো ভালো হবে। মাখানোর পর হাতে সময় থাকলে দশ থেকে পনের মিনিট রেখে দিতে হবে। চাইলে সাথে সাথেই চুলায় বসিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিলে যে সুবিধা হয় সেটা হল মাংস থেকে পানি টা তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে যায় এবং মসলাগুলো ভিতরে ভালোমতো ঢুকতে পারে। পনের মিনিট পর মেখে রাখা মাংসগুলোকে চুলায় বসিয়ে দিতে হবে। মিডিয়াম হাই হিটে মাংসগুলোকে রান্না করে নিতে হবে সাত থেকে আট মিনিট বা যতক্ষণ না এর থেকে পানিটা ছাড়ছে। ৭/৮ মিনিট পর ঢাকনা সরিয়ে ফেলতে হবে। দেখা যাবে মাংস থেকে পানিটা ছাড়তে শুরু করেছে। ঠিক এই পর্যায়ে এর মধ্যে এক টেবিল চামচ টকদই ঢেলে দিতে হবে। টক দই আগে থেকেই সামান্য পানিতে গুলিয়ে রাখতে হবে। তারপর এটা কে মাংসের সঙ্গে ঢেলে ভালোমতো নেড়ে মিশিয়ে দিতে হবে। দই আর মাংস থেকে বের হওয়া পানিতে মাংস টাকে ভালো মত কষিয়ে নিতে হবে। এরপর আবার ঢেকে দিতে হবে। তারপর যতক্ষণ না মাংস থেকে সম্পূর্ণ পানি বের হয়ে আবার টেনে যাচ্ছে ততক্ষণ এটাকে ঢেকেই রান্না করতে হবে। তবে মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে নেড়ে দিতে হবে যেন মাংস টি তলায় লেগে না যায়। এভাবেই মাংস গুলো ৮০% মতো সিদ্ধ হয়ে যাবে। এরপর মাংসটি আবার ঢেকে দিয়ে চুলার আঁচ একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। পানি একেবারে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে মাঝে মাঝে অবশ্যই ঢাকনা খুলে এটাকে নেড়ে দিতে হবে। সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর ঢাকনা খুললে দেখা যাবে মাংসটা বেশ সুন্দর একটা কালার হয়েছে যদিও কালো ভাবটা তখনও পুরোপুরি আসবেনা তবে মাংসটা খুব ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে যাবে। কালা ভুনা রান্নার একটা বৈশিষ্ট্য হলো মাংসটা তুলতুলে নরম থাকে তবে একদম ভেঙে যায় না। এরপর চুলার আঁচ বাড়িয়ে মিডিয়াম করে দিতে হবে। এরপর মিডিয়াম আঁচে মাংসটাকে নেড়েচেড়ে কষাতে হবে। মাংসের মধ্যে যে ঝোল ঝোল ভাবটা আছে সেটাকে কমিয়ে শুকনো করে ফেলতে হবে। এভাবে মাংসটাকে কালচে করে ফেলতে হবে। তবে কোনোভাবেই মাংসের গায়ের মসলা পুড়িয়ে ফেলা যাবে না। কালা ভুনা মানে ভুনা কাল মাংস। মাংসকে ভেজে কালো করা যাবে না। যখন মাংস আর মসলা গায়ে গায়ে লেগে যাবে এবং কাল ভাব চলে আসবে সেই পর্যায় এর মধ্যে একটু করে পানি দিতে হবে। এক কাপ পরিমাণ পানি এমনভাবে একটু একটু করে দিতে হবে যাতে করে এটা শুকাতে অনেক বেশি সময় না লাগে। পানিটা দেয়ার কারণ এটাই যে মাংসের মধ্যে যে মশলাটা আছে সেটা কোনভাবেই পুড়ে না যায়। এরপর আবার মাংসটাকে কষাতে হবে। পাঁচ থেকে ছয় বার এই প্রসেস করলেই দেখা যাবে মাংস এবং মসলা কালচে হয়ে এসেছে। এরপর মাংসটাকে আর ড্রাই না করে নামিয়ে নিতে হবে হালকা ভেজা ভেজা থাকা অবস্থায়। এরপর বাগার দিতে হবে। যেটা কালো ভুনা রান্নার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বাগারের জন্য চুলায় একটি প্যান গরম করে নিতে হবে। প্যান্ট এর উপরে ২/৩ পরিমাণ তেল ঢেলে দিতে হবে। বাগারের জন্য চারটা শুকনা মরিচ, দুইটা মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ কুচি নিতে হবে। গরম তেলে পেঁয়াজের কুচি ঢেলে দিতে হবে। শুকনা মরিচ একসঙ্গে দেওয়া যাবে না কারণ পেঁয়াজ কুচি ভাজা হতে একটু সময় লাগবে। পেঁয়াজ কুচি গুলোকে সোনালি করে ভেজে নিতে হবে। পেঁয়াজ অর্ধেক ভাজা হয়ে গেলে শুকনা মরিচ ছেড়ে দিতে হবে। এরপর এই বাগারটা সরাসরি কালা ভুনায় ঢেলে দিতে হবে। এরপর ভালোমতো নেড়ে নিতে হবে। এরপর মিডিয়াম আঁচে তিন থেকে চার মিনিট রান্না করে নিতে হবে। এরপর ফিনিশিং হিসেবে হাফ চা চামচ ভাজা জিরা গুড়ো, ১/৪ চা চামচ জয়ফল এবং জয়ত্রীর গুঁড়ো, রাধুনী গুঁড়ো যেটা চট্টগ্রামের যেকোনো খাবারের একটা ঐতিহ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর এই তিনটা মসলা কালা ভুনার উপর দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর মিডিয়াম আঁচে তিন থেকে চার মিনিট নেড়েচেড়ে রান্না করে নামিয়ে নিতে হবে। হয়ে গেল ভীষণ সুস্বাদু চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কালা ভুনা। আপনি গরম গরম ভুনা খিচুড়ি বা পরোটার সাথে এই কালা ভুনা
পরিবেশন করতে পারেন।