একসময় মাসকলাইয়ের ডালের সহজলভ্যতার কারণে কুষ্টিয়া অঞ্চলে কালাই রুটির ব্যাপক প্রচলন হয়। মাঠে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষের জন্য এই রুটি ছিল প্রতিদিনের খাবার। আকারের দিক থেকে কালাইয়ের রুটি সাধারণ রুটির প্রায় দ্বিগুন, সেটা ব্যাসার্ধ আর পুরুত্ব দুই হিসেবেই। আটার মিশ্রণের ওপর নির্ভর করে রুটির রং কেমন হবে। কালাইয়ের আটা বেশি থাকলে রুটি শক্ত হবে, আর চালের আটা বেশি দিলে রুটি হবে নরম। তবে সাধারণ রুটি, পরোটার তুলনায় কালাইয়ের রুটিকে শক্তই বলতে হবে।
সব উপকরণ একসঙ্গে পরিমাণ মতো মিশিয়ে পানি দিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়। সেই মন্ড থেকে একটি টেনিস বলের আকারের সমান মন্ড তুলে একটি রুটি বানানোর কাজ শুরু হয়। এই রুটি বেলুনিতে বেলা হয় না। হাতের তালু আর আঙুল দিয়ে চেপে চেপে অনেকটা নৃত্যের ভঙ্গিতে সেই গোল মন্ডকে গোলাকার রুটির রূপ দেওয়া হয়। রুটি সেঁকা হয় বিশেষ আকৃতির মাটির পাত্র বা খোলায়। রুটি সেঁকার এক পর্যায়ে তা ফুলে উঠে অন্যান্য রুটি, পরোটার মতো করেই। তবে এখানেই রুটি দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। আটার রুটি, পরোটা আগাগোড়াই নরম। তবে কালাইয়ের রুটির নিচের অংশটা নরম আর ওপরের অংশ কুড়মুড়ে চিপসের মতো।
কালাইয়ের রুটির প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে তা গরম অবস্থায় খেতে হবে। এই রুটি মূলত সকালের নাস্তার পদ হলেও অনেকে রাতেও খান আজকাল। এই রুটি খেতে হয় লবন আর বেগুনের সানা দিয়ে। পেঁয়াজ ও মরিচ কুচি, শুকনো মরিচ বাটা দিয়ে বানানো লবণ আর সরিষার তেলের মিশ্রণ। স্থানীয় ভাষার এই মিশ্রন ‘লবন’ নামে পরিচিত। অনেক সময় তাতে যোগ করা হয় ধনেপাতা-বাটা চাটনি।
এককালের গৃহস্ত বাড়ির মানুষগুলোর এমন অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রুটির সঙ্গে। রুটিকে ঘিরে এই গল্পগুলো তাই কোনো নথিভুক্ত ইতিহাস নয়। শুধু স্বাদ নয়, ওই স্মৃতিগুলো আবার মনে করার জন্য হলেও কৃষিকাজ ছেড়ে দিলেও কালাইয়ের আজও ক্ষেত থেকে ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত সবখানেই শোভা পায় সগৌরবে।
কালের বিবর্তনে সব অঞ্চলেই কৃষিজীবী গেরস্ত বাড়ি কমেছে, কালাইয়ের চাষ কমেছে। একসময় যে রুটি সব ঘরেই তৈরি হত, আজ তা ভেড়ামারাতে অনেক ঘরে সৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে।
ঘরে কালাইয়ের রুটির সহজলভ্যতা কমলেও স্থান পেয়েছে দোকানে। বাস কিংবা রেলস্টেশনের আশপাশে এই রুটির দোকান সবচাইতে বেশি চোখে পড়বে। দোকান আর রুটির আকারভেদে দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
দোকানে যারা রাতে খেতে আসেন তাদের অনেকেই শখ করে আসেন। অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রথম দর্শনে ও স্বাদে এই রুটি এক বিস্ময়কর খাবার হিসেবেই টিকে থাকবে।