কালাভুনা নাম শুনে জিভে জল আসে না এমন মানুষ বাংলাদেশে খুজে পাওয়া খুব কঠিন হবে। কালাভুনা চট্টগ্রাম এর ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার যা বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশেই বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। কালাভুনার উৎপত্তি ১৭শ শতকের দিকে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই পদটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় প্রচুর নানা রকম মসলা। নানা রকম মসলার মিশ্রনে রান্না করার ফলে মাংস ভুনায় কালো রং আসে বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে কালাভুনা।
মেজবান মানেই যেন কালাভুনার রেসিপি। মেজবানও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠান। বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকায় কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর আকিকা, জন্মদিবস উপলক্ষে, ব্যক্তিগত সাফল্য, নতুন কোনো ব্যবসা আরম্ভ, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, পরিবারে আকাঙ্ক্ষিত শিশুর জন্ম, বিবাহ, খৎনা, মেয়েদের কান ছেদন এবং ধর্মীয় ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মেজবানির আয়োজন করা হয়। আর এই মেজবানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকে কালা ভুনা।
মেজবান ছাড়াও বিয়ে, ঈদ বা রমজানে সাহরি বা ইফতারেও কালাভুনা একটি জনপ্রিয় আইটেম হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রধানত ভাত, পরোটা, নান রুটি কিংবা রুটির সাথে কালাভুনা খাওয়া হয় আমাদের সমগ্র বাংলাদেশে।
কালা ভুনা তৈরির প্রক্রিয়াঃ
পাঠক জিভে জল আনা কালাভুনা কিভাবে তৈরি করতে হয় আসুন জেনে নেই তার উপকরন সমূহ ও রন্ধন প্রণালি। কয়েক দফায় মশলা প্রয়োগ ও বাগাড় দিতে হয় বলে আমরা সেই অনুযায়ী উপকরণ গুলো বিন্যাস্ত করেছি।
ক) প্রথম দফা উপকরণঃ
১) গরুর মাংস (হাড় চর্বি সহ) = ১কেজি।
২) আদাবাটা = ১ টেবিল চামচ।
৩) রসুনবাটা = ১ টেবিল চামচ।
৪) লাল মরিচের গুড়া = ২ চা চামচ।
৫) হলুদের গুড়া = ১ চা চামচ।
৬) ধনিয়ার গুড়া = ১ টেবিল চামচ।
৭) জিরার গুড়া = ১ টেবিল চামচ।
৮) লবণ = ১ টেবিল চামচ।
৯) গরম মসলা = ২ চা চামচ।
১০) পিয়াজ বেরেস্তা = ১ কাপ।
১১) পেয়াজ কুচি= হাফ কাপ।
১২) টক দই = ৪ টেবিল চামচ।
১৩) তেজপাতা = ৩ টা।
১৪) দারুচিনি = ৩ টা।
১৫) এলাচ = ৪/৫ টা।
১৬) তারামণী = ২ টা।
১৭) বড় এলাচ = ২ টা।
১৮) লং = ৫/৬ টা।
১৯) বেরেস্তা ভাজা তেল= হাফ কাপ।
২০) সরিষার তেল = হাফ কাপ।
খ) দ্বিতীয় দফা উপকরণঃ
১) জয়ফল গুড়া = ১/৪ চা চামচ।
২) জয়ত্রী গুড়া = ১/৪ চা চামচ।
৩) রাধুনী স্পেশাল মশলা= ১/২ চা চামচ।
৪) জিরা গুড়া = ১ চা চামচ।
৫) গোল মরিচের গুড়া = ১ চা চামচ।
গ) বাগাড় দেয়ার উপকরণঃ
১) সরিষার তেল = ১/৪ কাপ
২) পেয়াজ কুচি = ১/৪ কাপ।
৩) রসুন কুচি = ৪/৫ কোয়া।
৪) শুকনা মরিচ = ৪/৫ টা।
প্রস্তুত প্রণালিঃ
কালাভুনা তৈরির জন্য আমরা প্রথমে একটি রান্না করার পাত্রে ১ কেজি পরিমাণ হাড় চর্বি সহ পরিস্কার করে ধোয়া গরুর মাংস নেব। মাংসগুলো ছোট ছোট টুকরোয় কাটা হতে হবে। এরপর প্রথম দফায় বর্ণিত উপকরণ গুলো (আদাবাটা, রসুনবাটা, লাল মরিচের গুড়া, হলুদের গুড়া, ধনিয়ার গুড়া, জিরার গুড়া, লবণ, গরম মশলা, পিয়াজ বেরেস্তা, পিঁয়াজ কুঁচি, টক দই, তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচ, তারামনী, বড় এলাচ, লং, বেরেস্তা ভাজা তেল, সরিষার তেল) উল্লেখ্য পরিমাণমত একের পর এক মাংসের সাথে মেশাতে হবে। এরপর খুব ভালমত মশলাগুলো মাংসের সাথে মেখে নিতে হবে।
এমনভাবে মাখতে হবে যেন প্রত্যেকটা মশলা মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। মশলা মাংসের সাথে মাখানো কালাভুনা রাঁধায় অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারন এর উপরেই কালাভুনার আসল স্বাদ নির্ভর করে। এভাবে ভালমত সব উপকরণ মাখানোর পর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে মাংসটি ১ ঘন্টার জন্য ম্যারিনেট করতে রেখে দিতে হবে।
১ ঘন্টা পর মাংস ম্যারিনেট হয়ে গেলে একে চুলায় বসাতে হবে। তারপর উচ্চ তাপে ১০ মিনিট রান্না করতে হবে। এভাবে উচ্চ তাপে রান্না করলে মাংস থেকে পানি বেরিয়ে আসবে। তখন চুলার আঁচ নিম্ন মধ্যমে রেখে ঢাকনা দিয়ে মাংসটি ৩০ মিনিট রান্না করতে হবে। ৩০ মিনিট পর ঢাকনাটি খুলে ভালমত মাংসগুলো নেড়েচেড়ে দিতে হবে। এরপর চুলার আঁচ আবারো নিম্ন মধ্যম এ রেখে রান্না করতে হবে আরো ৩০ মিনিট।
মাংস চুলায় বসানোর ১ ঘন্টা পর দেখা যাবে মাংসের পানি গুলো উবে গেছে এবং উপরের তেল গুলো ভেসে উঠেছে। এ অবস্থায় মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ করতে মাংসে ১ কাপ পানি দিতে হবে। তারপর চুলার আচ একদম নিম্ন রেখে রান্না করতে হবে আরো ৩০ মিনিট।
৩০ মিনিট পর মোট দেড় ঘন্টায় মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ হয়ে যাবে। এই পর্যায়ে মাংসে আরো কিছু মশলা মেশাতে হবে। উপরে বর্ণিত দ্বিতীয় দফার উপকরণগুলো (জয়ফল গুড়া, জয়ত্রী গুড়া, রাধুনী বিশেষ মশলা, জিরা গুড়া, গোল মরিচের গুড়া) এবার মাংসে দিতে হবে এবং আবারো নেড়েচেড়ে মাংসের সাথে ভালমত মিশিয়ে দিতে হবে। এই পর্যায়ে আস্তে আস্তে কালা ভুনার কালো রঙ আসতে শুরু করবে। আবার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রান্না করতে হবে প্রায় ৩০ মিনিট।
মোট ২ ঘন্টা পর মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ হয়ে কালা ভুনায় পরিণত হবে। তবে কালাভুনার আসল স্বাদ আনতে এতে বাগাড় দিতে হবে। বাগাড় দেয়ার জন্য একটি চুলায় একটা প্যান বসিয়ে তাতে ১/৪ কাপ সরিষার তেল দিতে হবে। এরপর উপরে বর্ণিত বাগাড় দেয়ার পরিমান অনুযায়ী পেঁয়াজকুচি, রসুনকুঁচি, শুকনা মরিচ এতে দিতে হবে। পেঁয়াজ বেরেস্তার মত হয়ে আসতে নিলে প্যান থেকে বাগাড় মাংসে ঢেলে দিতে হবে। এরপর মাংসটা অল্প আঁচে পাঁচ মিনিট রেঁধে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু, মজাদার, ঐতিহ্যবাহী, মুখরোচক কালাভুনা।
পাঠক আজ এ পর্যন্তই। আশা করি কালাভুনার মজার রেসিপি আপনাদের অনেক তৃপ্তি দেবে। পোস্টটি কেমন লাগলো দয়া করে কমেন্টে জানাবেন, যদি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার করবেন, পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।